– সুব্রত মণ্ডল সৃজন।
আমরা সবাই অবগত আছি যে, বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে সমগ্র পৃথিবী এক ভয়ংকর মহামারীতে আক্রান্ত। সমগ্র পৃথিবী যখন এই মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, তবুও থেমে নেই বিশ্ব, থেমে নেই মানুষ এবং মানুষের কর্ম। যদিও এই মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, হচ্ছে সমগ্র বিশ্ববাসী। একটা সময় গেছে যখন করোনার ভয়ে আমরা সবাই আপন আপন ঘরে বন্দী অবস্থায় ছিলাম, কাজ-কর্ম যা করার, যা করা যেত ঘরে থেকেই করতাম। বিশেষ কোনো প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হতাম না। কিন্তু তারপর একটা সময় আসলো তখন আর মানুষ ঘরে আবদ্ধ থাকলো না মানুষ বের হয়ে পড়ল ঘরের বাইরে। এর পেছনেও আছে অনেক কারণ। মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে, মানুষকে কাজ করতে হবে। আর বেঁচে থাকার মত কাজ করতে হলে একসময় দেখা যায় সবকিছুকে উপেক্ষা করে ঘরের বার হতেই হলো। কিন্তু আবার ভয়ঙ্কর সেই করোনা ছোবল মেরেছে আমরা আবার লকডাউনে চলে এসেছি জানি না কতদিন সময় লাগবে এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে বা কতদিন এরকম ভাবে আমাদেরকে চলতে হবে।
আর এরই মাঝে ঝরে গেল অসংখ্য প্রাণ এই মহামারিতে, মহামারীর মহা ছোবলে! কত মা হারাল তার সন্তানকে! সন্তান হারালো তার মা-বাবাকে! এভাবে কত পরিবার থেকে কত যে জীবন ঝরে গেল তার হিসাব হয়তো এখনো শেষ হয়নি। কবে যে এর হিসাবের খাতার পাতা পূর্ণ হবে তা বলা মুশকিল!
হয়তো আমরা অনেকেই মনে করেছিলাম যে, যেহেতু সবকিছু খুলে দিয়েছে, হাট-বাজার অফিস-আদালত ইত্যাদি। সেহেতু বুঝি করোনা ভাইরাস বলতে আর কিছু নেই। হয়তো অনেকটা মনের ভীতি! এক সময় আমরা পেলাম, করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং প্রয়োগও হয়েছে পৃথিবীর কিছু দেশে, আমরাও পেয়েছি। আমরা হয়তো অনেকেই করোনা ভাইরাসকে কিছু মনে না করে, বিধি নিষেধ পালন না করে ঘরের বাইরে যাই ঘোরাফেরা করি। অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধিকে তেমন কোন প্রাধান্য অনেকেই দেই না। আবার অনেকেই আমরা মানি। আসুন আমরা সকলেই নিয়ম মেনে জীবন যাপন করি সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ি, গড়ি সোনার বাংলাদেশ, গড়ি সুন্দর পৃথিবী!
এখন বলবো বাংলার সংগীত জগতের কিছু গোপন কথা। করোনা ভাইরাস যেহেতু মুখ চিনে চিনে আক্রমন করে না, তাই ছাড় পায়নি সংগীত জগতের মানুষও। সঙ্গীত জগতের অনেকেই আছেন যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন এখন সুস্থ। অনেকেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন আবার অনেকেই করেননি, শীতের সময়ও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই, সেখান থেকেও কেউ কেউ গণমাধ্যমে প্রকাশ করছেন আবার কেউ কেউ করেননি, বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন। তার ভিতর থেকে এ যাবৎ যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকেও বরণ করে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে এবং এখনো যারা আক্রান্ত আছেন। এছাড়া করোনাকালে আমরা হারিয়েছি যাদের, তাদের নিয়ে জেনে নেবো-
করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন যারা-
নকীব খান, যিনি বাংলাদেশের একজন গায়ক, গীতিকার এবং সুরকার। মন শুধু মন ছুঁয়েছে, এখন অনেক রাত, তুমি বললে, ভাল লাগে জোসনা, তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে, যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, এমন অসংখ্য গানের সুরকার তিনি।
হামিন আহমেদ, যিনি একজন বাংলাদেশী সংঙ্গীত শিল্পী এবং তিনি ব্যান্ড দল ‘মাইলস’ এর সদস্য।
তাহসান রহমান খান, যিনি ‘তাহসান’ নামেই সমধিক পরিচিত, বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, গিটার বাদক, কী-বোর্ড বাদক, পরিচালক, অভিনেতা, মডেল এবং উপস্থাপক।
মোমিন বিশ্বাস, প্লেব্যাক কণ্ঠশিল্পী।
রাজীব ইসলাম, সঙ্গীতশিল্পী।
বিখ্যাত সুরকার ওস্তাদ শেখ সাদী খান প্রমুখসহ আরো অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন বলে জানা যায় বিভিন্ন মাধ্যমে।
এবার দেখি আমরা হারালাম কোন কোন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং কাকে কবে ?
ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান, একজন বাংলাদেশী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সরোদ বাদক ও সুরকার ছিলেন। (২৮ নভেম্বর, ২০২০)।
জানে আলম, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও প্রযোজক ছিলেন। বাংলা পপ সঙ্গীতের স্রষ্টা ও প্রচারক হিসেবে যে পাঁচজন শিল্পীকে মনে করা হয় উনি তাদের একজন। (২মার্চ, ২০২১)।
ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, একজন বাংলাদেশী লোকগানের শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, জারি, সারি, মুর্শিদি ইত্যাদি গাইতেন। পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীও ছিলেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে সংগীত বিভাগে একুশে পদক প্রদান করে। (৭ এপ্রিল, ২০২১)।
এসপি বালা সুব্রহ্মণ্যম, ভারতের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী এবং সংগীত জগতে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন তিনি। (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০)।
বীনা মজুমদার, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত পল্লীগীতি শিল্পী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক বছর ধরেই নিউইয়র্কে বসবাস করতেন। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ( ১৪ এপ্রিল, ২০২০)।
সুরের যাদুকর আলাউদ্দীন আলী, যিনি একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত বরেণ্য সঙ্গীতব্যক্তিত্ব। (৯ আগস্ট, ২০২০)।
ফরিদ আহমেদ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত সংগীত পরিচালক ও সুরকার। (১৩ এপ্রিল, ২০২১)।
প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর, ক্যানসারে ভুগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ এন্ড্রু কিশোর। (৬ জুলাই, ২০২০)।
সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী সুরকার, সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী। জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো, ভালোবাসার মূল্য কত, ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই, মনেরও রঙে রাঙাব, ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’সহ বিখ্যাত গানগুলোর সুরকার। বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তিনি। (১৬ মে, ২০২০)।
মিতা হক, রবীন্দ্র সঙ্গীতের অন্যতম শিল্পী হিসেবে তিনি দুই বাংলায় জায়গা করে নিয়েছিলেন নিজের যোগ্যতায়। তিনি ছায়ানটের শিক্ষক এবং ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত বিভাগের প্রধান’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতে মিতা হকের গানের ১৪টি এলবাম প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ১০টি। সঙ্গীতে নিষ্ঠা ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করেন।
বর্তমানে করোনাক্রান্ত অবস্থায় আছেন যারা, তাদের মধ্যে-
তপন চৌধুরী, একজন বাংলাদেশী গায়ক, গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীতপরিচালক। তিনি সোল্স ব্যান্ডের সাবেক সদস্য। সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে তিনি সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৭৯ সালে তিনি জনপ্রিয় ব্যান্ড দল ‘সোলস’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম। (আক্রান্ত)
ফরিদা পারভিন, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী। তিনি মূলত পল্লীগীতি গেয়ে থাকেন, বিশেষ করে তিনি লালন সঙ্গীতের জন্য বেশি জনপ্রিয়। জন্ম নাটোরে হলেও বড় হয়েছেন কুষ্টিয়ায়। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারে নজরুল সঙ্গীতের জন্য নির্বাচিত হন। (আক্রান্ত)
এছাড়াও আমরা দেশে-বিদেশের অসংখ্য গুনী মানুষদেরকে হারিয়েছি এই মহামারী করোনায় এবং বিভিন্নভাবে এই করোনাকালেই! অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন (কিছু প্রকাশিত বা কিছু অপ্রকাশিত)। যা সৃষ্টি জগতে বিশাল ক্ষতিই বলতে হয়, যা চিরদিনের জন্য অপূরণীয়!
পরিশেষে, সঙ্গীতাঙ্গন পরিবারের পক্ষ থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা যে, তুমিতো সর্বশক্তিমান আর মানুষতো তোমার সৃষ্টির সেরা জীব, তাই তুমি তোমার কাছে দোয়া এই মহামারী থেকে সকল মানুষকে তথা তোমার সৃষ্টিকে রক্ষা করো। মহামারী নামক এই কালো হাত তুমি ধ্বংস করে দাও। নতুন করে সাজাও তোমার পৃথিবী তোমার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মাধ্যমে। মানুষ আর চায় না খারাপ পথে যেতে, মানুষ এখন তোমার পথেই থাকতে চায়। আর যারা এই মহামারিতে তোমার ইশারায় মৃত্যুকে বরণ করেছে তাদেরকে তোমার কাছেই ঠাঁই দিও, এই প্রার্থনা তোমার কাছে হে প্রভু!