– রহমান ফাহমিদা।
বহমান নদীর মত মানুষের জীবনের গন্তব্যও একই দিকে প্রভাহিত হয় না। পরিস্থিতি অনেক সময় বাধ্য করে নিজের কাজের পাশাপাশি অন্য কিছু করার। যার প্রতিভা আছে সে হয়তো তখন দু’টো কাজ একসাথে করার পারদর্শিতা দেখাতে পারে। তেমনই একজন মানুষ, জনপ্রিয় সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার এবং সঙ্গীত শিল্পী নকীব খান। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’, ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট’ -এমন অনেক অনেক জনপ্রিয় গানের সুরকার তিনি।
নকীব খান ১৮ মার্চ ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আইয়ুব খান। তিনি চট্টগ্রামের কাজেম আলী হাইস্কুলের আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং গানের খুব ভক্ত ছিলেন। নকীব খানের মা আক্তার জাহান খানও সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। নানা ‘কাওয়াল’ ছিলেন। কলকাতা থেকে তাঁর লং প্লে বের হয়েছিল। তাছাড়া বড় ভাই জালাল উদ্দিন খান জিলু চট্টগ্রাম বেতারের নামকরা সুরকার ছিলেন এবং তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন। ‘বার্লাক’ নামে তাঁদের একটি ব্যান্ড দল ছিল। ব্যান্ডের বাদ্যযন্ত্র গুলো নকীব খানদের স্কুল কম্পাউন্ডের বাসায়ই থাকত। তাঁরা প্রাক্টিস করতেন। বড় ভাই গান গাইতেন, বাজাতেন এসব দেখে দেখেই নকীব খান এবং তাঁর ছোট ভাই শাহবাজ খান পিলুর গান শেখা শুরু। ছোট ভাই শাহবাজ খান পিলুও ড্রামার, ভোকালিস্ট, গীতিকার ও সুরকার।
কৈশোরেই ব্যান্ড সঙ্গীতের সাথে জড়িয়ে পড়েন নকীব খান। ‘বার্লাক’ নামের ব্যান্ডে গায়ক ও পিয়ানোবাদক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। কিছুদিন গান করার পর বার্লাক ছেড়ে যোগ দেন সোলস-এ। সোলস হল স্বাধীনতা যুদ্ধের পর। ১৯৭২ সালে, সাহেদ-উল-আলম এর নেতৃত্বে তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘সুরেলা’ নামের একটি অর্কেস্ট্রা দল। ১৯৭৪ সালে যার নাম পরিবর্তিত করে রাখা হয় ‘সোলস’। সাজেদ, লুলু ও রনি তখন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। প্রখ্যাত শিল্পী তপন চৌধুরী ও আহমেদ নেওয়াজের পরপরই নকীব খান ১৯৭৪ সালে সোলসে যোগ দেন। নকীব খান সোলসে যোগদানের পর সোলসে নিজেদের সুর ও কথায় গান কম্পোজ করা হয়। নকীব খান ‘সোলস’-এর কি-বোডিষ্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। তখন ব্যান্ড ‘বার্লাক’ -এর কি বোর্ড, ড্রামসহ সব বাদ্যযন্ত্র ‘সোলস’ কিনে নিয়েছিল। এসব বাদ্য যন্ত্র দিয়েই ‘সোলস’ -এর যাত্রা শুরু হয়। তপন চৌধুরী তখন সোলসে গান করেন। তপন চৌধুরীর জনপ্রিয় গান ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি নকীব খান নিজে ও তাঁর বড় ভাই সুরকার জালাল উদ্দিন খান জিলু, দুজনে মিলেই লিখেছেন এবং সুর করেছেন।
নকীব খান-এর গায়ক হওয়ার কোনো সখ ছিল না। সোলস-এর মূল গায়ক ছিলেন তপন চৌধুরী। ফলে বেশিরভাগ গানই তাঁকে দিয়ে গাওয়ানো হত। নকীব খান কি বোর্ড বাজাতেন আর গানের সুর করতেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে গায়ক হয়ে যান। ১৯৮০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সোলসের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শো’র আগে হঠাৎ করেই তপন চৌধুরী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে আসতে পারলেন নাহ! ফলে তপন চৌধুরীর গানগুলো নকীব খান নিজেই গান এবং দর্শক শ্রোতাদের মনে গায়ক হিসেবে জায়গা করে নেন। সেই থেকেই গায়ক হিসেবে তাঁর পথ চলা।
নকীব খান সোলস-এর সাথে কাটিয়েছেন প্রায় ১০ বছর। এরপর তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর ব্যক্তিগত কারণে চট্রগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং গড়ে তোলেন নিজের ব্যান্ড ‘রেনেসাঁ’। ১৯৮৫ সালে নকীব খান সোলস ছেড়ে ঢাকায় আসার পর এই ব্যান্ড গঠন করেন। রেনেসাঁ’র জন্মের তিন বছর পর ‘রেনেসাঁ’ নামের অ্যালবামটি বাজারে আসে। প্রথম অ্যালবামটিতেই নিজেদের প্রতিভা বিকাশের কথা শ্রোতাদের জানান দিতে সক্ষম হয় ব্যান্ড দলটি।
তারপর ১৯৯৩ সালে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামে দ্বিতীয়, ১৯৯৮ সালে ‘৭১-এর রেনেসাঁ’ নামে তৃতীয় এবং ২০০৪ সালে ‘একুশ শতকের রেনেসাঁ’ নামে চতুর্থ অ্যালবামটি বাজারে আসে। এরপর আর ‘রেনেসাঁ’ ব্যান্ডের আর কোনো অ্যালবাম বাজারে আসেনি। ২০১৮ সালে তাঁদের নতুন অ্যালবাম বাজারে আসার কথা থাকলেও নানান জটিলতায় সেই অ্যালবাম আর প্রকাশ হয়নি। দীর্ঘ ১৭ বছরের বিরতি ভেঙে নতুন গান নিয়ে আসছে ব্যান্ড দল ‘রেনেসাঁ’। নতুন এই গানের শিরোনাম ‘আকাশ আমার জোছনা আমার’। গীতিকার জুলফিকার রাসেলের কথায় এই গানে সুরারোপ করেছেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন পিলু খান। ইতিমধ্যে গানটির রেকর্ডিং সম্পন্ন করেছেন তাঁরা। যেহেতু এই ব্যান্ডের সকলেই চাকরি করেন এবং কেউ কেউ অন্য পেশায় যুক্ত আছেন তাই ব্যস্ততার কারণে নতুন অ্যালবামের কাজ করতে একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে রেনেসাঁ ব্যান্ডে যুক্ত আছেন নকীব খান, পিলু খান, রেজাউর রহমান, ইমরান রহমান, কাজী হাবলু ও কার্তিক।
‘আকাশ আমার জোছনা আমার’ শিরোনামের গানটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২৬শে মার্চ ধ্রুব মিউজিক স্টেশনের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হবে ভিডিওর মাধ্যমে। পাশাপাশি গানটি শুনতে পাওয়া যাবে একাধিক অ্যাপে।
‘সঙ্গীতাঙ্গন’ -এর পক্ষ থেকে ব্যান্ড দল রেনেসাঁ’র প্রতিষ্ঠাতা নকীব খানের জন্য রইল জন্মদিনের অনেক অনেক শুভকামনা ও শুভেচ্ছা এবং সেই সাথে দীর্ঘ বিরতির পর ‘রেনেসাঁ’ ব্যান্ডের নতুন গানের আগমন উপলক্ষে রইল একরাশ লাল গোলাপের অভিনন্দন।