– মোশারফ হোসেন মুন্না।
গ্রামবাংলার মাঠ-ঘাটের গানে রয়ে গিয়েছে মা-বোনের জীবনের কথা ও গাঁথা। রয়ে গিয়েছে আর্তি। স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষার গল্প। যে সব গল্পের প্রত্যেকটি শব্দ মর্মস্পর্শী। আবার কোনও গানে বিচ্ছেদের করুণ সুর। এমনই এক ধরনের মেঠো গানের বিষয় হল ‘রঙ্গুম’। প্রায় গোটা চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রচলিত ছিল ‘রঙ্গুম-রঙ্গিলা’-র কথা। লোকে বলত বহতা কর্ণফুলীর স্রোতে মিশে থাকে বাংলার মা বোনের রঙ্গুমি কষ্ট। বিষয়টা আসলে কী?
তখন পরাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলা। বাংলার ছেলেরা নানা জাতীয় জিনিসের ব্যবসার তাগিদে তখন পাড়ি দিচ্ছে বার্মা-রেঙ্গুন দেশে। আজকে যে দেশের নাম মায়ানমার। আমরা জানি বার্মা-রেঙ্গুন যাওয়ার গল্প লিখে গিয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। এই রেঙ্গুনকেই বাংলার মা-বোনেরা বলতেন ‘রঙ্গুম’। তাঁদের কাছে রঙ্গুম মানেই হল রহস্যে মোড়া এক রঙিন দেশ। যে দেশে বাংলার ছেলেরা একবার গেলে আর ঘরে ফেরে না। ঘরের ছেলে যাতে ‘রঙ্গুম’ না যায় তাই তাঁরা থানে (প্রার্থনার স্থান) মানত করতেন আর সঙ্গে ব্রত পালন করতেন। তাঁদের মনে থাকত চাপা ভয়। তাঁরা জানতেন ওই দেশের মেয়েরা জাদু জানে, ঠোঁটের ডগায় ফুল নিয়ে, চোখের ইশারায় বাংলার ছেলেদের ঘায়েল করে।
তাই ছেলে আর ঘরে ফেরে না। এই কারণেই মায়ের আকুতি থাকত ছেলের কাছে। ছেলেকে মা বলতেন বা অঙ্গীকার করতেন ভালো হালের গরু দেবেন, সুন্দরী কন্যার সাথে বিয়ে দেবেন, সব করবেন। কিন্তু ছেলে যেন ‘রঙ্গিলা’-র দেশে না যায়।
এখান থেকেই তৈরি হয়েছিল রঙ্গুম রঙ্গিলার গান। বাংলার লোকগানের বিস্তৃত তালিকায় এই গান নেই। ভাটিয়ালি, জারি, সারি, বাউল, বিচ্ছেদির তালিকায় এ গান স্থান পায় না। কিন্তু কেউ কেউ গাইতেন এই দুর্লভ সমাজভিত্তিক গান। তাঁদেরই একজন অনামা মহম্মদ হারুন। যাঁরও সাল ঠিকুজি অধরা (গানের শিরোনাম)। তিরিশের দশকে এমন একটি দুর্লভ গান মহম্মদ হারুনের কণ্ঠে ধরা হয়েছিল এইচ.এম.ভি-র রেকর্ডে। ৭৮ ঘূর্ণনেরই রেকর্ড এটি। কিন্তু আকারে ছোট। আর লেবেলের রং কমলা। রেকর্ডের গানটি এক কথায় সমাজের এক বিশেষ দলিল। বলতে গেলে, মা আর পুতের বিচ্ছেদ বেদনার আর্তি এই গান।