– মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না।
হারিয়ে যাওয়া যত একস্টিক যন্ত্র তার মধ্যে এস্রাজ হচ্ছে অন্যতম। দিনের সাথে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এসব সঙ্গীত শ্রষ্ঠা যন্ত্রগুলো। যা আর কিছুদিন পর যাদুঘরে খুঁজতে যেতে হবে। বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীদের যেমন চিড়িয়াখানায় খুঁজতে হয় তেমনি হবে একস্টিক যন্ত্রের বেলায়। এধরনের যন্ত্রের হাত ধরেই সঙ্গীতের সুর, তাল, লয়, তান সৃষ্টি হয়েছে। এস্রাজের পরিচয়টা সবার কাছে তেমন ভালো না। অনেকেই এস্রাজ নামের সাথেই পরিচিত না। আমরা সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে এই ব্যাতিক্রম ধর্মীয় যন্ত্রের পরিচয় ও গঠন কাঠামো তুলে ধরছি। এস্রাজ হচ্ছে একটি তার যন্ত্র। এই যন্ত্রটি মূলতঃ ভারতীয় উপমহাদেশেই ব্যবহৃত হয়। এর উৎপত্তিও খুব বেশী দিন আগে নয়। আনুমানিক ২-৩ শত বৎসর আগে, হাজার বছর ধরে প্রচলিত সারেঙ্গীর সরলরূপ হিসাবে যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয়। বলা হয় এস্রাজ সেতার ও সারেঙ্গীর সমন্বিত রূপ। এস্রাজের ব্যবহার দেখা যায় মূলতঃ পূর্ব ও মধ্য ভারতে এবং বাংলাদেশে। এটি তারের ওপর ছড় টেনে বাজাতে হয়। মূলত সঙ্গতকারী যন্ত্র হিসেবেই এস্রাজ ব্যবহৃত হলেও এটিতে পূর্ণ গানের সুর তোলা সম্ভব। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে এস্রাজের সঙ্গত শ্রুতিমধুরতা সৃষ্টি করে।
এস্রাজের আরেকটি রূপ হলো তারসেহনাজ। এস্রাজের সমরূপ আরেকটি বাদ্যযন্ত্র রয়েছে যা দিলরুবা নামে পরিচিত। এটি ভারতের উত্তরাংশে সচরাচর ব্যবহৃত হয়। ধর্মীয় সঙ্গীত ও হালকা রাগপ্রধান সঙ্গীতে দিলরূবা ব্যবহৃত হয়। নির্মিতির দিক থেকে ঐক্য থাকলেও দিলরুবার বাদন পদ্ধতি ভিন্ন।
এস্রাজ এবং দিলরুবা উভয়েরই কাঠামো ও গঠন শৈলী প্রায় অভিন্ন। মাঝারি আকৃতির সেতারের মত ডান্ডির উপর ২০টি ধাতব ঘাট বেঁধে দেয়া হয়। এগুলোর উপর ১২ থেকে ১৫টি সহমর্মী সুরের বা তরঙ্গের তার বাঁধা হয়। দিলরুবায় অবশ্য এরচেয়ে বেশী সংখ্যক তার ব্যবহৃত হয়, এ কারণে দিলরুবার পাটাতনটি একটু চওড়া হয়ে থাকে। দু’টো যন্ত্রেই প্রধান তার চারটি। এগুলো বেহালার মতো ছড়ের সাহায্যে বাজানো হয়। নিচের অংশ সেতারের লাউয়ের তুম্বার পরিবর্তে কাঠের ছোট তুম্বাকৃতির খোলের উপর তবলার উপরিভাগের মতো ছাগলের চামড়ার ছাউনি দিয়ে টান টান করে বাঁধা হয়। উল্লেখযোগ্য যে সারেঙ্গীতে ব্যবহৃত হতো প্রাণীজ তার, অন্যপক্ষে এস্রাজ ও দিলরুবায় ধাতব তার ব্যবহার হয়।
বাদক জোড় আসনে বসে বাজিয়ে থাকেন। বাম কাধেঁ যন্ত্রের গ্রীবাটির ভর রেখে ভূমিতে এস্রাজ স্থাপন করা হয়। এরপর ডান হাতে ছড় টানা হয় এবং বাম হাতে তারের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে বিষ্ণুপুরের আশিষ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে এস্রাজের শিক্ষকতা করেছিলেন। তাঁর শিষ্য রণধীর রায় এস্রাজবাদক হিসাবে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য আমরা আধুনিকতার ছোঁয়াতে এই ধরনের যন্ত্র হারাতে বসেছি। আমাদের উচিত এই যন্ত্রগুলোকে যাদুঘরে না পাঠিয়ে যন্ত্রশিল্পীর হাতে তুলে দেওয়া। বিভিন্ন সংঘটনের কাছে আমাদের এটাই প্রত্যাশা থাকবে তারা যেন একস্ট্রিক যন্ত্র গুলোর ব্যবহার আবার ফিরিয়ে আনেন। আর যন্ত্র শিল্পীদের তাদের কাজের মর্যাদা দেওয়া হক সেই কামনায়।