– কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
ওরে ভাইরে ভাই
বাংলাদেশে বাঙালী আর নাই।
যারা ভীড় করে এই পথে ঘাটে
বাঙাল যাদের বল,
তাদের স্বদেশে যে নিজের দশা
করে টলমল।।
বাঙালী তো হিন্দুরা বাংলা ভাষা তাদের,
হুজুর যা কয়, ঠিক কথা, আলবৎ হইবে জরুর,
-বলে বাঙালী খান পাঠান ওরা
মীরজাফরের চাঁই।।
আজব কথা-
গাঁজার নৌকা পাহাড় দিয়া যায়,
জলে ভাসে শিলা কিবা বানরে গীত গায়,
ওরা ধানের গাছে খেঁজুর খোঁজে
লাজে মরে যাই!
শোনেন হুজুর-
বাঘের জাত এই বাঙালেরা
জান দিতে ডরায় না তারা,
তাদের দাবী বাংলা ভাষা
আদায় করে নেবে তাই।। – গীতিকবি-আনিসুল হক চৌধুরী
১৯৪৮-এ বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান সম্পর্কে অনেকেই জানেন না! যে গান আর না গাওয়ার জন্য সেই গানের শিল্পীকে, পুলিশের কাছে বন্ড সই দিতে হয়েছিল এবং পুলিশ সেই লেখা গানের কাগজ শিল্পীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ঐ গান নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন, বাংলাদেশে ইংরেজী ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প সময় পরে বাংলাদেশের গণসঙ্গীতের অগ্রনায়ক তথা প্রতিবাদী গানের জনক প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার শেখ লুৎফর রহমান তাঁর লেখা ‘জীবনের গান গাই’ বইটিতে। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, সাহিত্য প্রকাশনী থেকে এবং প্রকাশক ছিলেন, মফিদুল হক। এই গানের বিষয় লেখা আছে এই বইয়ের ৪৬/৪৭/৪৮ পৃষ্ঠায়। একুশের প্রথম ঐ গানটির সুরকার ও শিল্পী তিনি নিজেই এবং গীতিকার ছিলেন, আনিসুল হক চৌধুরী। মরমী শিল্পী আবদুল আলীমের গাওয়া ‘রূপালী নদীরে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’ এই জনপ্রিয় গানটির গীতিকারও ছিলেন তিনি।
প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমানের কিছু কথা – দেশ বিভাগের পরে ১৯৪৭-এর অক্টোবরের মাঝামাঝি ঢাকায় এসে আমি জিন্দাবাহার লেনের একটি বাড়িতে উঠি। সরকারের বরাদ্দ করা বাড়ি ছিল সেটা। বাড়িটার চারপাশে অভব্য নোংরা পরিবেশ। সার্বিক পরিবেশ সেখানকার তাই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না-যেমন, আরও পারছিলাম না স্থানীয় লোকজনের আচরণ ব্যবহার মেনে নিতে। মনে হচ্ছিল, এসব লোক এখনো ঘুমিয়ে আছে। এদের ঘুম ভাঙাতে হবে। ঢাকা বেতারে গান গাই। অনেকেই তাই চেনে। ফরমায়েশ আসে আধুনিক গানেরই বেশী। এ গানে ঘুমের ভাব আসে। তাই ঘুম ভাঙানী গানের দরকার-ক’দিন ঘুরে দেখে মনে হয়েছে যা।
১৯৪৮-এ মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর ঢাকা বেতারের হিন্দু শিল্পী ও গীতিকারগণ একে একে চলে গেলেন ঢাকা ছেড়ে। গান লেখার মানুষেরও তখন বড়ই অভাব! কবি আনিসুল হক চৌধুরী গান লেখেন রেডিওর জন্য, আধুনিক, পল্লীগীতি। তিনি আমার বন্ধু হয়ে গেলেন ক’দিনেই। তাঁকে বললাম, মনের কথা আমার। বললাম, ঘুম পাড়ানী আধুনিক গান নয়, ঘুম ভাঙানী গান গাইব আমি। তাই লিখে দিতে হবে। কবি লিখে দিলেন-
‘শুধু ঘুম পাড়ানী গান আজি নয়
কর্মের আহ্বান এলো আজ ধরাময়’-
গানটির সুর করে গাইবার পর ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় এ দেশে। বাইরে গাইবার পরে রেডিও-তেও গেয়েছি গানটি। এমন কি প্রখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিনও এই গানটি গেয়েছেন, গানটির কথা ও সুরে আকৃষ্ট হয়ে। এদেশের প্রথম গণসঙ্গীতও এই গানটি।
১৯৪৮-এ কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ এ দেশে প্রথম এসেই ঘোষণা করলেন -‘রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দু হবে’। সমস্ত বাঙালী গর্জে উঠল-না-না-না। বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সভা হতে লাগল। কবি আনিসুল হক চৌধুরীকে বললাম গান লিখে দিতে। কবি লিখে দিলেন বাংলাভাষার প্রথম গান, ওরে ভাইরে ভাই/বাংলাদেশে বাঙালী আর নাই… তাদের দাবী বাংলা ভাষা/ আদায় করে নিবে তাই।(উপরে উল্লেখিত গানটি)।
গানটি প্রথমে গাই জগন্নাথ কলেজে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস.এম হলে। সেখান থেকে পুলিশ গানটি কেড়ে নিয়ে এক ধরনের বন্ডে আমার দস্তখন নিয়ে সাবধান করে দিয়ে বলে যায় যে, আর কখনো এই গান গাইলে এ দেশে থাকা হবে না আমার। গানটি তাই বেশী গাইতে পারিনি। কিন্তু সমস্যা তো দিন দিন বাড়ছিল এবং কবি আনিসুল হক ও আমি আলোচনা করতাম। সে সব সমস্যার উপরে কবি যথারীতি গান লিখে নিয়ে আসতেন আর আমি সুর করে তা গাইতাম। এ দেখে কবি অকবি অনেকেই তখন গান লিখে আমার বাড়িতে এসে তাদের গান একবার দেখার জন্য অনুরোধ করতেন। তাদের সে সব গানের মধ্যে কেটে কুটে ঘষে মেজে ঠিক করে কিছু গান আমি গেয়েছি, তাদের অনুরোধের মর্যাদা দিতে। তবে কবি আনিসুল হক চৌধুরীর গানই আমি বেশী গেয়েছি তাঁর গানের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে।
১৯৮৬-তে বাংলা একাডেমীতে ভাষার গানের একটা ক্যাসেট প্রকাশ করার সময় আমাকে ডাকলেন। আমি বললাম, কি গান গাইতে হবে ? তাঁরা বললেন, ভাষা আন্দোলনের উপর ৫২ থেকে ৫৪-র মধ্যে যে কোনও বিশেষ গান কিন্তু আমি যখন বললাম, ভাষার ব্যাপারটাতো আমাদের কাছে এসেছে ইংরেজী ১৯৪৮-এ এবং সে সময়ে কবি আনিসুল হক চৌধুরীর লেখা গানটিই ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান। গানটির কয়েক লাইনও আমি তাঁদের গেয়ে শুনাই। তাঁরা বললেন, আমরা তো সে গান শুনিনি। বললাম, গানটি সেই সময় পুলিশ কেড়ে নেয়ায় ও বন্ডে আমার দস্তখত নিয়ে পুনরায় গানটি গাইলে আমাকে এ দেশে থাকতে দিবে না বলে সাবধান করে দেয়া হয়, গানটি বেশী গাইতে পারিনি। আমার এ কথায় তাঁরা বললেন, লুৎফর ভাই, গানটিতো প্রচার হয়নি! আমি বললাম, প্রচার না হলেও এবং আপনারা কেউ শুনে না থাকলেও সে সময়ে অনেকেই শুনেছেন। তাই আমি আপনাদের জানাচ্ছি। কবি আনিসুল হক চৌধুরীতো আপনাদের কাছে এ কথা বলতে আসেননি! তিনি একজন প্রচার বিমুখ কাজের মানুষ। আমি গানটি গেয়েছি তাই আমি জানি, তাঁরই লেখা গান। কেননা, তাঁর থেকে গানটি নিয়েই ভাষা আন্দোলনের
শুরুতে ঐ গানটি আমি সুর করেছি এবং গেয়েছি। এখন আপনারা এড়িয়ে যেতে চাইলেও এ কথা সত্য যে, ঐ গানটিই ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান।
শেখ লুৎফর রহমান
২৭শে জুন, ১৯৯২
২৯, পাতলা খান লেন, ঢাকা।
১৯৪৮ সালে রচিত এই গানটি ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান তা আমরা প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী লুৎফর রহমানের স্বঘোষিত বক্তব্যের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। হয়তো অনেক আগেই গানটি ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান হিসেবে স্বীকৃতি পেত! যেহেতু এই গানের শিল্পী পুলিশের বন্ডে দস্তখত করেছিল যে, সে আর এই গান গাইবে না। কারণ তাহলে তো তাঁকে সেই সময় এ দেশ থেকে বিতাড়িত করে দিত। অন্যদিকে, প্রখ্যাত গীতিকার আনিসুল হক ছিলেন প্রচারবিমুখ! তাই হয়তো গানটি আর প্রকাশ বা তেমনভাবে প্রচার হয়নি! তবে প্রতিটি সৃষ্টির ইতিহাস সবসময়ই সত্যের মুখমুখি দাঁড়ায়। দুঃখের বিষয় এই যে, যে মানুষগুলো নিজের শ্রম দিয়ে, সাধনা দিয়ে, মানসিক মেধাকে কাজে লাগিয়ে কিছু সৃষ্টি করে যায়, সেই সৃষ্টির মূল্যায়ন বেঁচে থাকতে পায় না।
সঙ্গীতাঙ্গন সব সময় চায়, সেই সকল কাজের ও মানুষকে মূল্যায়ন দিতে। তাইতো তাঁদের কথা বলার এবং জানার অপেক্ষায় থাকে সঙ্গীতাঙ্গন। আজকে এই গানের প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী, দু’জনেই চলে গেছেন এই পৃথিবী থেকে কিন্তু মানুষের জন্য রেখে গেছেন তাঁদের অতুলনীয় সৃষ্টি। সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে রইল তাঁদের জন্যে অসীম শ্রদ্ধা এবং সেইসাথে তাঁদের পরিবারের সকলের জন্য রইল শুভকামনা।