– মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না।
গম্ভীরা গান এক প্রকার জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত। সাধারণত বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে এ গান প্রচলিত। ‘গম্ভীরা’ হচ্ছে এক প্রকার উৎসব। ধারণা করা হয় যে, গম্ভীরা উৎসবের প্রচলন হয়েছে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে। শিবের এক নাম ‘গম্ভীর’, তাই শিবের উৎসব গম্ভীরা উৎসব এবং শিবের বন্দনাগীতিই হলো গম্ভীরা গান। গম্ভীরা উৎসবের সঙ্গে এ সঙ্গীতের ব্যবহারের পেছনে জাতিগত ও পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে। গম্ভীরা গান পরিবেশনের দৃশ্য আদিতে গম্ভীরা ছিল দুপ্রকার: আদ্যের গম্ভীরা ও পালা-গম্ভীরা। দেবদেবীকে সম্বোধন করে মানুষের সুখ-দুঃখ আদ্যের গম্ভীরার মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো। কখনও কখনও সারা বছরের প্রধান প্রধান ঘটনা এ গানের মাধ্যমে আলোচিত হতো। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্যা তুলে ধরা হতো। চৈত্র-সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হতো।
বর্তমানে ‘গম্ভীরা’ বলতে বিশেষ একটি অঞ্চলের লোকসঙ্গীতকে বোঝায়। গম্ভীরা গানের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় হিন্দুসমাজে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মালদহ থেকে গম্ভীরা গান রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে আসে। ওই সময় থেকে এ গানের পৃষ্ঠপোষক হয় মুসলিম সমাজ। তখন স্বাভাবিকভাবে গানের আঙ্গিক ও বিষয়বস্ত্ততে পরিবর্তন সূচিত হয়। ক্রমে রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নওগাঁ প্রভৃতি স্থানে এ গান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গম্ভীরা গানে সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা হয় এবং তার সমাধানও বলে দেওয়া হয়। পূর্বে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের অস্তিত্ব কল্পনা করা হতো। বর্তমানে শিবের পরিবর্তে ‘নানা-নাতি’র ভূমিকায় দুজন অভিনয় করে। তাদের সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সংলাপ ও গানের মাধ্যমে কোনোও একটা বিষয় তুলে ধরা হয়। গানের একটি ধুয়া থাকে; সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে গানগুলি ধুয়ার সুরে গীত হয়। এভাবে নানা-নাতির নাচ, গান, কৌতুক, অভিনয়, ব্যঙ্গ প্রভৃতির মাধ্যমে গম্ভীরা গানে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়। এ সময় তাদের বাকচাতুরী, উপস্থিত বুদ্ধি এবং অঙ্গভঙ্গি সবাইকে মুগ্ধ করে। নানার পোশাক
হলো লুঙ্গি; এ ছাড়া তার মুখে থাকে পাকাদাঁড়ি, মাথায় মাথাল, হাতে লাঠি; আর নাতির পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা ইত্যাদি। এক সময় গম্ভীরা গান একতাল, ত্রিতাল, দাদরা, খেমটা, কাহারবা প্রভৃতি সুরে গাওয়া হতো।
বর্তমানে সুরের পরিবর্তন ঘটেছে এবং তাতে হিন্দি ও বাংলা ছায়াছবির গানের সুর প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ছাড়া লোকনাট্যের বহু বিষয়, চরিত্র ও সংলাপও গম্ভীরা গানে সংযুক্ত হয়েছে। নবাবগঞ্জের কুতুবুল আলম, রকিবউদ্দীন, বীরেন ঘোষ, মাহবুবুল আলম প্রমুখ গম্ভীরা গানের বিশিষ্ট শিল্পী। তাঁরা নতুন নতুন সুর সৃষ্টির মাধ্যমে গম্ভীরা গানকে সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।