– মোশারফ হোসেন মুন্না।
বাংলাদেশের আপামর-সাধারণের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই লালন সঙ্গীত এবং ফরিদা পারভীন পরস্পর পরিপূরক এবং অবিচ্ছিন্ন দু’টি নাম। লালন সাঁইজির গানের প্রসঙ্গ উঠলেই বাঙালীর মন-কানে প্রথমেই যাঁর কন্ঠস্বর ও সুর বেজে ওঠে, তা নিশ্চিতভাবেই ফরিদা পারভীনের। দীর্ঘদিন তিনি দূর কুষ্টিয়া শহরে বসে লালন সঙ্গীতের চর্চা করেছেন এবং সেখান থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠা। দূর মফস্বল শহরে বাস করে লালন সঙ্গীতের মতো একটি বিশেষ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে ফরিদা পারভীন ছাড়া আর কারো নেই। কুষ্টিয়াতে অবস্থানকালেই তিনি লালন সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক এবং অনন্ত প্রেম ছবিতে ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটি গেয়ে ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
ফরিদা পারভীন ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। প্রায় সারাক্ষণ তিনি দৌড়-ঝাঁপ আর খেলাধুলা করে বেড়াতেন। সঙ্গীতাঙ্গন এর সাথে আলাপকালে শৈশবের স্মৃতিচারণা করেন তিনি। তাকে প্রশ্ন করা হয় শৈশবের কোন স্মৃতি মনে পড়ে কিনা ? আর তিনি বলতে থাকেন তার সেই ছোট্টবেলার দিনগুলির কথা। তিনি বলেন, আমার দাদা এবং নানার বাড়ির মাঝখানে ছিল একটি নদী। নদীটির নাম ছিল গুর। এটি ছিল আত্রাইয়ের শাখা নদী। গ্রাম্য এলাকা। আমার সাথে আমার খালাতো মামাতো বোনেরা ছিল। দিনের বেশিরভাাগ সময় আমরা দাদা বাড়ি থেকে নানা বাড়িতে চলে যেতাম। আর নানার বাড়ির পাশে ছিল বিরাট একটা বিল। নদী পার হয়েও তাই তাঁর অবসর ছিল না। খেলার সাথী মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে শাপলা তুলতে যেতাম সেই বিলে। শুধু তাই-ই নয় বিলের মধ্যে থাকতো ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। ওই সব নৌকাতে চেপে বিল থেকে শাপলা তুলে আনতাাম। শুধু তাই নয় সাথীদের সাথে পাখির বাসা দেখতে এবং মাঠের পর মাঠ হইচই করতে খুব ভালো লাগতো। আবার যখন খুব বেশি গরমের সময় আসতো নানা বাড়ির আমবাগানের নীচে পাটি বিছিয়ে মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে শুয়ে থাকতাম। তখন আমার আর কোনো ভাইবোন ছিল না। আমি ছিলাম পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। এভাবে আর কি আমার ছোটবেলার দিনগুলো কেটেছে। তার কাছে জানতে চাওয়াা হয় গানের জগতে কিভাবে চলে আসা। জবাবে তিনি বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই একটু একটু গান করতাম। সেই জন্য মামা খালারা আমাকে ভালোবাসতো। ছোটবেলায় আমি সবসময়ই গান গাইতাম। সারাক্ষণই আমার মুখে গান লেগেই থাকত। বলতে গেলে গানের সাথে পথচলাটা সেই ছোটবেলা থেকেই। গানকে আমি ভালোবাসি খুব ছোট বয়স থেকেই। যেকোনো ধরনের গান আমি সারাদিন গাইতাম।
শিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর গান বেশি বেশি শুনতাম। সত্যি বলতে আমি জানতামই না আসলে তিনি যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ শিল্পীর গান ভালবাসতাম কিন্তু তাকে জানতাম না চিনতাম না। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান আমি রেডিওতে শুনতাম। তার গান শুনে শুনে আমি উচ্চারণ ঠিক করতাম। তখন আকাশবাণী বেতার এ সকাল পৌনে নয়টায় আধুনিক গানের অনুষ্ঠান হতো। আমি তখন সংগীতের বিষয়গুলো কিছুই বুঝতাম না। আকাশবাণীর সেই গানের অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আলী হোসাইন সানাই বাজাতেন। অসাধারণ সেই সুরটা আমাকে মুগ্ধ করত। এমন হয়েছে গান শুনতে শুনতে আমি কেঁদে ফেলেছি। ছোটবেলা আমাকে অনেক আবেগাপ্লুত করতো। বলতে গেলে সেটাই আমার অনুপ্রেরণা গানের জন্য। আমার বড় মামা গানের খুব ভক্ত ছিল অবশ্য তিনি গান গাইতেন না। তবে যেখানে গানের আসর বসতো তিনি চলে যেতেন। রীতিমত এটা ছিল তার অভ্যাস। আমার নানা বাড়ির কাছাকাছি হিন্দু সমাজের একটা প্রভাব ছিল। আর তাদের সাথে মামার খুব বন্ধুত্ব ছিল। ধর্ম নিয়ে তখন মানুষের মধ্যে তেমন কোন কুসংস্কার ছিলনা। নানা বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে তারা আমাদের অনুষ্ঠানে আসতো এবং ওদেরও কোন অনুষ্ঠান হলে আমরা যেতাম। কোন কোন দিন মামা কোত্থেকে যেন একটা হারমোনিয়াম নিয়ে এসে বলতেন ফরিদা গান করতে দেখি কেমন গান করিস। আর আমিতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে আনন্দের সহিত গান গাইতে শুরু করি। নানাবাড়িতে সন্ধার পরে উঠোনে পাটি বিছিয়ে গানের আসর বসতো। বড় মামা আমার গান শুনে বলতেন আমার ফরিদার মত এত সুন্দর কন্ঠ আর কার আছে শুনি ? আমার মাকে মামা বলতেন, দেখিস রৌফা আমার ফরিদা যা হবে না ? আসলে ছোট বেলার সেই দিনগুলি আমাকে খুব আন্দোলিত করে। নানাদের আম বাগানে খেলা বিলে গিয়ে শাপলা তোলা আবার গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করা সব কিছু আমার মনে পড়ে। তবে আনন্দের বিষয়ের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে আমি সব সময় এক জায়গায় স্থির থাকতাম না। তার কারণ হলো আমার বাবা মেডিকেলে চাকরি করতেন আর সেই সুবাদে আমি এক এক সময় বাবার সাথে এক এক জায়গায় থাকতাম। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করা সেটা আমার কাছে এক ধরনের আনন্দ। আমার বড় হওয়ার এক জায়গায় থেকে নয় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে। ফরিদা পারভীন বলেন আমার গানের হাতেখড়ি হয় মাগুরা জেলায়। ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা। তখন আমার বয়স চার কি পাঁচ বছর হবে। আমাকে গানের হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। তবে এরপর থেকে যেখানে থেকেছি সেখানে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে গান শিখেছি। মাগুরা গার্লস স্কুল থেকে যখন কুষ্টিয়া গার্লস স্কুলে আসি তখন আমার স্কুলের টিচার ছিল ও ওস্তাদ ইব্রাহিম। তিনি আমাকে ক্লাসিক্যাল গান শেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন আমি মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ি। তার পরামর্শে আমি ক্লাসিক্যাল গান শেখা শুরু করে দিই। তারপর আরেকটু বড় হয়ে কুষ্টিয়ার গানের ওস্তাদ রথীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গনির কাছে ক্লাসিক্যাল গান শেখা। ৭ বছর তানপুরার সঙ্গে ক্লাসিক্যাল চর্চা করার পর আমি নজরুল সঙ্গীত শিখতে শুরু করি নজরুল সঙ্গীত শেখার প্রথম শুরু হচ্ছে আব্দুল কাদেরের কাছে। তারপর মেহেরপুরের মীর জাফর আলীর কাছেও নজরুলসংগীত শিখি নজরুলের গান হারমোনিয়াম ও তোলার কাজটি আমি ওস্তাদ মীর জাফরের আলীর কাছেই শিখেছি। আমার আনন্দটা আর একটু বেড়ে যায় ১৯৬৮ সালে যখন আমি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী নির্বাচিত হই। লালন সাঁইজির গানের সাথে তার আপোষহীন মেলামেশাটা কখন থেকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। তখন আমারা কুষ্টিয়াতে থাকি। সেখানে আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন গুরু মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা তাঁর কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শিক্ষার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন বলে জানান। পরে মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালন সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন। ফরিদা পারভীনের কর্মজীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, শুধু লালনের গান নয়, আমি একাধারে আধুনিক এবং দেশাত্মবোধক গান গেয়েছি আমার গাওয়া আধুনিক এবং দেশাত্মবোধক গান কিংবা লালন শাহের গান সমানভাবে জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে উদযাপনসহ যে কোনো জাতীয় দিবস পালনের সন্ধিক্ষণ এলে এদেশের সর্বত্র ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীর তটে’ গানটি অবধারিতভাবেই শোনা যায়। আবার আধুনিক গানের প্রসঙ্গ উঠলে এদেশের মানুষ এক বাক্যে স্মরণে আনে ফরিদার গাওয়া- ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’ এবং ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কী সাধ আছে বলো’ গান দুটিকে। তবে, সব ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে ফরিদা পারভীনের প্রধান পরিচয় লালন সঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গায়কীর কারণেই লালনের গান আজ আমাদের সবার কাছে এত প্রিয়। জনপ্রিয় এই শিল্পীর গান দিয়েই ট্রানস্ক্রিপশন সার্ভিস শুরু হয়। ফরিদা পারভীন বলেন আমি ঢাকায় চলে আসি, তারপর মোকসেদ আলী সাঁই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে একটা বেতার ছিল সেখানে আমি লালনের কিছু গান গাই। তখন আমাকে গাইতে অনুরোধ করা হয় খাঁচার ভেতর, বাড়ির কাছে আরশিনগর এই গানগুলো।
লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। বর্তমান শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের দরবারেও তিনি এখন লালন সাঁইজির বাণী ও সুরকে প্রচারের কাজে আত্মনিবেদিত আছেন। ইতোমধ্যে তিনি জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ আরো বহু দেশে লালন সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।
ফরিদা পারভীন লালন সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পান। এর বাইরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র ‘অন্ধ প্রেম’-এ সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। আজ তার জন্মদিনে সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
Hey there just wanted to give you a brief heads up and let you know a few of the pictures aren’t loading properly.
I’m not sure why but I think its a linking issue. I’ve tried it in two different browsers and both show the same outcome.