asd

কে তুমি হে সখা – শহীদ মাহমুদ জঙ্গী…

বাড়ীর সামনের দেওয়াল ছুঁয়ে বোগেনভিলিয়া গাছ। আঙ্গীনায় একটি মাঝারি টেবিলের উপর পানের বাটা। টেবিলের পেছনে চেয়ারে বসা বাবা। টেবিলের সামনে কিছুটা জায়গা খালি রেখে আরেকটি চেয়ারে বসে দুই চোখ বন্ধ করে একতারায় নিমগ্ন হয়ে গান গেয়ে চলেছেন, আব্বাস ফকির। একহারা গড়ন। পরনে সাদা লুঙ্গী, খদ্দরের চাঁদরে শরীর ঢাকা। মাঝে এক-দুইবার কিছুটা সময়ের জন্য বিশ্রাম, চা পান। আবার গান। গেটের বাইরে, আমার বাবার নামে নামকৃত রাস্তায় (এল, এ চৌধুরী সড়ক) গান শোনার জন্য ততক্ষণে ছোট একটা ভিড় হয়ে যেতো। গান শেষ হলে আব্বাস ফকিরের সারা মুখে সুখের হাসি ছড়িয়ে পরতো।

গাওয়া গানগুলোর মধ্যে যে তিনটি গানের কথা এখনো মনে আছে : মওলানা বজলুল করিম মন্দকিনি মাইজভান্ডরীর লেখা –
‘কে তুমি হে সখা আড়ালে বসিয়া হরিলে আমারো প্রাণ,
ছলনা কৌশলে জগত মজালে
এমনো মোহিনী জান।’

কবিয়াল রমেশ শীলের লেখা –
‘গউসল আজম বাবা নুরে আলম তুমি ইসমে আজম জগত তরানেওয়ালা
তোমার নুরেতে পাহাড়ও জ্বলে
বাবা, মুসা নবী হইলো নুরে উতলা।’

কবি রমেশ শীলের লেখা –
‘চলো মন তরা যাই
বিলম্বের আর সময় নাই
গউসল আজম মাইজ ভাল্ডারী
স্কুল খুইল্যাছে
স্কুল খুইল্যাছরে মওলা স্কুল খুইল্যাছে
গউসল আজম মাইজভান্ডারী স্কুল খুইল্যাছে।’

কবিয়াল রমেশশীল ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার গোমদন্ডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে ৬ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি রমেশ শীল গণমানুষের জন্যও লিখেছেন। সূর্যসেন-প্রীতিলতার কথাও উনার গানে এসেছে। উনি মাইজভান্ডারীর অনুসারি ছিলেন। এই ধারার অনেক গান উনার লেখায় উঠে এসেছে। বাংলা একাডেমী তাঁর সমগ্র রচনাবলী প্রকাশ করেছে। রমেশ শীলের মাইজভান্ডারি গান এখনো জনপ্রিয়।
আব্বাস ফকির প্রায় প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে এসে আব্বাকে গান শুনিয়ে যেতেন। আব্বাস ফকির গানে এমনভাবে ডুবে যেতেন যে আশেপাশের কোন শব্দই গানের প্রতি উনার মনযোগের বিচ্যুতি ঘটাতে পারতো না। আমরা মুগ্ধতা নিয়ে উনার গান শুনতাম।

আমার বাবা এল, এ, চৌধুরী রাজনীতি করতেন কিন্তু একসময় উনার পরিচিতির ব্যাপ্তি ঘটে সমাজসেবক হিসেবে। সমাজসেবাসহ অন্যান্য কর্মকান্ডের মধ্যেই উনি সময় করে নিতেন গান শোনার। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পীরা বাসায় আসতেন। বাবাকে গান শুনিয়ে যেতেন। উনি রবীন্দ্র সংগীত-নজরুল সংগীত, সমকালীন এবং পুরাতন দিনের গান পছন্দ করতেন।
আমার আম্মা হামিদা চৌধুরীর পছন্দ ছিলো রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত থেকে শুরু করে আধুনিক গান। সময় সুযোগ পেলেই উনি গুনগুন করে গান গাইতেন। আম্মার পছন্দের গান একসময় আমাদেরও প্রিয় গান হয়ে যায়। উনি গুনগুন করে গাইতেন- ‘তুমি তো কেবলই ছবি/ শুধু পটে আঁকা’।
কখনো নজরুল সংগীত। যেমন- ‘শুকনো পাতার নুপুর পায়ে/ নাচিছে ঘুর্নিবায় জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল/ ঢেউ তুলে সে যায়’।

কবি আল্লামা ইকবালের অসাধারণ সব লেখা সর্বমহলের প্রশংসা অর্জন করেছিলো। ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর, পাকিস্তানের শিয়ালকোটে আল্লামা ইকবালের জন্ম। উর্দুসাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে উনাকে বিবেচনা করা হয়। একজন কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ হিসাবে উপমহাদেশে উনার ভালো জনপ্রিয়তা আছে। উনার লেখা, –
‘সারা জাহাসে আচ্ছা/ হিন্দুস্তান হামারা’
এই গানটিও আম্মা গুনগুন করতেন।
আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে উনার থেকেই প্রথম জেনেছি। ২১ এপ্রিল ১৯৩৮ সালে কবি ইকবাল পাকিস্তানের লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন। ‘সারা জাহাসে আচ্ছা’ গানটি ভারতে এখনো তুমুল জনপ্রিয়।
আম্মা, অনেক সময় গানের পেছনের গল্পও বলতেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়, বৃটিশ মেজিস্ট্রেট ডগলাস কিংস ফোর্ডকে স্বধীনতাকামী বিপ্লবীরা অত্যাচারী হিসাবে চিহ্নিত করে। এবং তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এবং এই দায়িত্ব পালনের জন্য ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ক্ষুদিরামদের ছোড়া বোমা যে বাহনে আঘাত করে, ঐ বাহনে সেদিন ডগলাস ছিলেন না। ডগলাস ছিলেন অন্য বাহনে। বোমার আঘাতে দুইজন মহিলা মারা যান। প্রফুল্ল চাকি পুলিশের হাতে ধরা পরার আগেই আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তখন ক্ষুদিরামের বয়স ১৮ বছর ৮ মাস ১১ দিন। সন-তারিখ বাদে, বাকি গল্প আম্মা থেকে শোনা। এই গল্প বলা শেষ করে, উনি বলতেন ক্ষুদিরামকে নিয়ে বিখ্যাত একটি গান আছে। আমরা শুনতে চাইলে, উনি গাইতেন- ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/ হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি/দেখবে ভারতবাসী’।

গানটি যতবারই শুনতাম, ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেতো। বড় হয়ে জেনেছি পিতাম্বর দাসের লেখা ও কম্পোজিশানে গানটি গেয়েছেন লতা মুঙ্গেশকার। পিতাম্বর দাস সম্পর্কে চেষ্টা করেও খুব একটা বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৩ সালে মুক্তি পায়, অশোক কুমার-মুমতাজ শান্তি অভিনীত ছায়াছবি ‘কিসমত’। জ্ঞান মুখার্জি পরিচালনা করেছিলেন। সংগীত পরিচালক ছিলেন অনিল বিশ্বাস। গান লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। এই ছবির গান ‘দূর হঁটো দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হ্যায়’ সুপার-ডুপার হিট হয়, সেই সাথে ছায়াছবি ‘কিসমত’ পায় ব্যাপক সাফল্য। ভারতের প্রথম গোল্ডেন জুবলি ছবি।
‘দূর হটো দুনিয়াওয়ালো’ গানটি আম্মার কাছেই প্রথম শুনেছি। কিন্তু এই গান নিয়ে প্রাসঙ্গিক সবকিছু বড় হয়ে জেনেছি। গানটি গেয়েছিলেন, আমিরবাঈ কর্নাটাকি ও খান মাস্তানা।
দাদা সাহিব ফালকে পুরুস্কারপ্রাপ্ত কবি প্রদীপ ভারতের অত্যন্ত সম্মানিত কবি। উনার লেখা, লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া ‘এ্যই মেরে ওয়াতন কা লোগো’ ভারতের তিন-চারটি দেশাত্ববোধক গানের মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
লতা মুঙ্গেশকরের কন্ঠে এই গান শুনে জহর লাল নেহেরুর চোখ জলে ভরে উঠেছিলো। সেই গল্পও গানের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। কবি প্রদীপ ১৯১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
দেশাত্ববোধক গানের জন্য ভারতে তাঁকে এখনো অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়। গানের সুরকার অনিল বিশ্বাস বরিশালের সন্তান। ১৯১৪ সালের ৭ জুলাই তিনি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত গুনি এই মিউজিশিয়ান ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রচুর ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন। ২০০৩ সালের ৩১মে নতুন দিল্লিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের সবাক চলচ্চিত্রের প্রথমদিকের কান্ডারী অনিল বিশ্বাস তাঁর সৃজনশীল সংগীত প্রতিভায় শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। তাঁর বহু কালজয়ী গান এখন মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে আছে।
আব্বা আম্মার গানের প্রতি ভালবাসা, সেই একেবারে ছোট বেলায় কিছু বুঝার আগেই গুনগুন করে আমার মাঝেও ঠাঁই করে নেয়।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest Articles