Sunday, September 14, 2025

৪৯তম মহান বিজয় দিবসে সকলের জন্য রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা – সঙ্গীতাঙ্গন…

– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।

একটি গান যেমন পারে
জীবনের দুঃখ ভুলিয়ে দিতে,
তেমনই একটি সুর পারে
জীবনকে ছন্দময় করে নিতে।
সেই গানই হয় এক সময়
রণক্ষেত্রের হুঙ্কার!
বয়ে নিয়ে আসে সেই গান
বিজয়ের সম্ভার।…

একটি যুদ্ধে শত্রু পক্ষের অতর্কিত হামলায় যখন যোদ্ধারা তাঁদের মনোবল হারিয়ে ফেলে তখন সঙ্গীতই পারে তাঁদের মনোবল ফিরিয়ে দিতে এবং তাঁদের ক্লান্ত শরীরে শক্তি ফিরিয়ে আনতে। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ দেখিয়ে দিয়েছিল একটি যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখা যায়! আজকে ৪৯তম বিজয় দিবসে বলতে দ্বিধা নেই যে, মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল সঙ্গীত। সেই সময়ে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিকগণ রীতিমত যুদ্ধ করেছে তাঁদের কথা, সুর, সঙ্গীত ও কণ্ঠ দিয়ে। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল সঞ্চারে সহায়ক হয় নি! সেইসাথে যুগিয়েছে অনুপ্রেরণা। একই সাথে বাংলাদেশের অবরুদ্ধ মানুষের মনে জাগিয়েছে আশার আলো এবং শরণার্থীদের মনে যুগিয়েছে মানসিক শক্তি।

২৫ মার্চের কালো রাতে ঘুমন্ত মানুষের উপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হায়নার দল। তারা নির্বিচারে হত্যা করে শিশুসহ আবাল বৃদ্ধ বণিতাদের। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার। শুরু হল যুদ্ধ ও মুক্তির জন্য লড়াই। পাকিস্তানি শত্রুদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যার যা আছে তাইই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায় মানুষ! ভুলে যায় শ্রেনী ও পেশার ব্যবধান। শব্দ সৈনিকরাও পিছিয়ে নেই, মাতৃভুমিকে রক্ষার জন্য। কণ্ঠ সৈনিকরাও মাতৃভুমিকে রক্ষার জন্য সম্পৃক্ত হলেন সেই আন্দোলনে। যুদ্ধের পুরো নয়টি মাস স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হতে লাগল, প্রেরণা মুলক গান, মনকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দেশের গান এবং মায়ের গান। যুদ্ধের সময় অসীম সাহসিকতার সাথে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে একের পর এক কালজয়ী গান উপহার দিয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীবৃন্দ। জানা যায় যে, শিল্পীদের দল প্রথমে ১৭ জন দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে এর সংখ্যা দাড়ায় ১৭৭-এ। শুধু প্রতিষ্ঠিত শিল্পীই নন, যারা মোটামুটি গান গাইতে পারতেন তারাও এই দলে যোগ দিয়েছিলেন।
স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন শতাধিক শিল্পী তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন-
গীতিকারঃ- সিকান্দার আবু জাফর, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, টি এইচ শিকদার প্রমুখ।
শিল্পীঃ- সমর দাস, আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, সনজিদা খাতুন, অরুণ গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যাটার্জী, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, নমিতা ঘোষ, স্বপ্না রায়, অরুপ রতন চৌধুরী, জয়ন্তি লালা, অজিত রায়, সুবল দাশ, কাদেরী কিবরিয়া, শাহীন মাহমুদ, লাকী আখন্দ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশি, বুলবুল মহালনবীশ, ফকির আলমগীর, মাকসুদ আলী সাই, মোসাদ আলী, শেফালী ঘোষ, তিমির নন্দী, মিতালি মুখার্জী, মলয় গাঙ্গুলী, তপন মাহমুদ, রফিকুল আলম প্রমুখ।
যন্ত্র সঙ্গীতঃ- শেখ সাদী, সুজেয় শ্যাম, কালাচাঁদ ঘোষ, গোপী বল্লভ বিশ্বাস, হরেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী, সুবল দত্ত, বাবুল দত্ত, অবীনাশ শীল, সুনিল গোস্বামী, তড়িৎ হোসেন খান, দিলীপ দাশ গুপ্ত, দিলিপ ঘোষ, জুলু খান, রুমু খান, বাসুদেব দাশ, সমীর চন্দ্র,শতদল সেন প্রমুখ।

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ বেতার ছাড়াও বিভিন্ন স্টেজ শো করতেন। সেখানে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছিল অসাধারণ। স্টেজ শো করতে সহযোগিতা করতেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবি পর্যন্ত। স্টেজ শোর অর্থ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জামা-কাপড়, কম্বল থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্য কিনে দেয়া হত। সেসব সামগ্রী তাঁরা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিলি করতেন এবং শরণার্থী ক্যাম্পে দিয়ে আসতেন।
৪৯তম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের ১০টি উল্লেখযোগ্য গানের কথা তুলে ধরা হল পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে-
১/ জয় বাংলা বাংলার জয়-
এই গানটি দেশ বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহর কন্ঠে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সেরা গান। গানটির কথা লিখেছেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং সুর করেছেন আনোয়ার পারভেজ।
২/ কারার ঐ লৌহ কপাট-
এই গানটির কথা ও সুর করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর অনবদ্য এই গানটি কয়েকজন শিল্পীর সমবেত কন্ঠে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যুদ্ধকালীন সময়ে বার বার প্রচার হয়।
৩/ তীরহারা এই ঢেউর সাগর পাড়ি দেব রে-
একাত্তরের জুনের শেষের দিকে এই গানটি তৈরি করা হয়। এই গানের কথা ও সুরারোপ করেন আপেল মাহমুদ। যৌথভাবে আপেল মাহমুদ ও রথীন্দ্রনাথ রায়ের কন্ঠে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত গানের মধ্যে অন্যতম সেরা গান।
৪/ পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল-
এই গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। সুরারোপ করেছেন সমর দাস। গানটি কয়েকজন শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে প্রচার করা হয়।
৫/ মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি-
এই গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। সুর করার পাশাপাশি গানটিতে কন্ঠ দিয়েছেন শিল্পী আপেল মাহমুদ। এই গানটি যুদ্ধকালীন সময় এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
৬/ শোন একটি মুজিবরের থেকে-
এই গানটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুরারোপ করেন অংশুমান রায়। আব্দুল জব্বার এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
৭/ এক সাগরের রক্তের বিনিময়ে-
এই গানটি গোবিন্দ হালদারের কথায় সুরারোপ করেন আপেল মাহমুদ এবং গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন স্বপ্না রায়।
৮/ সালাম সালাম হাজার সালাম-
গানটি লিখেছেন ফজলে খোদা এবং সুরারোপ করেছেন ও কণ্ঠ দিয়েছেন আব্দুল জব্বার।
৯/ নোঙর তোল তোল-
গানটির কথা লিখেছেন নঈম গহর। সুরারোপ করেছেন সমর দাস। কয়েকজন শিল্পীর সমবেত কন্ঠে গানটি প্রচারিত হয় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে।
১০/ ছোটদের বড়দের সকলের-
এই গানটির কথা ও সুর খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার। এই গানটি জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী রথিন্দ্রনাথ রায়ের কন্ঠে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের পাশাপাশি বাঙ্গালীর বেদনাময় জীবনের কাহিনী সঙ্গীতের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন অনেক মহান শিল্পী। স্বাধীনতাযুদ্ধের অনুকূলে সঙ্গীতে প্রতিরোধের আসর বসেছিল লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে, বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাজায়। বিশ্বখ্যাত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার অংশ নিয়েছিলেন কনসার্টে। শিল্পী জর্জ হ্যারিসন ভারতের বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের অনুরোধে আয়োজন করেন ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ কনসার্ট। এই আসরে যোগ দেন স্পেনের রিংগো স্টার ও লিওন রাসেল, বিখ্যাত পপ গায়ক বব ডিলান, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের গায়িকা জোয়ান ব্যাজ, শিল্পী এরিক ক্ল্যাপ্টন, ভারতের সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শঙ্কর, সরোদ বাদক ওস্তাদ আলী আকবর খান ও তবলা শিল্পী আল্লারাখা। পন্ডিত রবি শঙ্কর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান বাজিয়েছিলেন, যুগলবন্দি ‘বাংলাদেশ ধুন’ বব ডিলান পরিবেশন করেন ছয়টি গান, জোয়ান ব্যাজ নিজের রচিত গানে সুরারোপ করে গাইলেন হৃদয় নিঙরানো গান, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। জর্জ হ্যারিসনের ‘দু’চোখে দুঃখ নিয়ে বন্ধু এলো’… গানটিতে আবেগ আপ্লুত হয়েছিল মানুষ। জাপানের তাকামামা সুজুকি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য।
তাই বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস ছিল সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের কারণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপন লড়াই করেছে শত্রুর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। সঙ্গীত দেখিয়েছে সাধারণ মানুষকে বিপর্যয় অবস্থাতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধকালীন সময় সঙ্গীত যুগিয়েছে মানুষের মধ্যে মানসিক শক্তি এবং বিজয়ের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সফল করেছে আমাদের মুক্তিসেনারা এবং ফিরিয়ে দিয়েছে বাংলার মানুষকে তাঁদের স্বাধীনতা এবং বিজয়ের পতাকা।
আজকে তাই বাংলাদেশের ৪৯তম বিজয় দিবসে সঙ্গীতাঙ্গন শ্রদ্ধা ভরে সালাম জানায় সেই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের যারা যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছেন এবং যারা এখনো বেঁচে আছেন। সঙ্গীতাঙ্গন শ্রদ্ধা ও স্যালুট জানায় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে। সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে সকলের জন্য শুভকামনা ও মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা রইল।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles

// DEBUG: Processing site: https://shangeetangon.org // DEBUG: Panos response HTTP code: 200 ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş betwinner melbet megapari megapari giriş betandyou giriş melbet giriş melbet fenomenbet 1win giriş 1win 1win