– সালমা আক্তার।
মানুষ কখনো কখনো স্বাভাবিক মানবোচিত গুনেরও উপরের স্তরে উঠতে পারে। এটা মানবিকবোধের পূর্ণ বিকাশের উপর নির্ভর করে। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানকে আমি ঠিক ওই স্তরের মানুষ হিসেবে অনুভব করেছি। এই যুগে এতোটা আত্মপ্রচারে অনাসক্ত মানুষ খুব কমই দেখেছি, নিজের আধ্যাত্ম সাধনার কারণে হয়তো হয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে। সবার মধ্যেই পরম সত্ত্বার উপস্থিতি দেখতে পান বলেই হয়তো সবার মঙ্গলের জন্য তিনি প্রার্থনা করেন। চেষ্টা করেন নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে হলেও অন্যের মঙ্গল করতে।
মানবতার চেতনায় জাগ্রত মহামানব মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান প্রতিনিয়ত গান, কবিতা, প্রবন্ধ, কলাম লিখন, চলচ্চিত্র, চিত্রনাট্য সংলাপ, আবৃত্তি, অঙ্কন ও নাট্যাভিনয়ে বারংবার ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন মানুষ ও মনুষ্যত্ববোধের জয়গান। তাঁর শব্দচয়ণের বৈচিত্র্যময়তায় উঠে এসেছে মানুষ ও মানুষের জীবনের সহজ সরল রূপচিহ্ন। অসাধারণ উপমায়, রূপকে, কিংবা প্রতিকের ছোঁয়ায় তুলে ধরেছেন হৃদয়ের চাওয়া পাওয়ায় মানুষ মানুষের জন্য কথার চিত্রকল্প, ক্যানভাসে তুলির অবিস্মরণীয় নকশায় এ যেন তুলনাহীন এক নব জাগরণের অপূর্ব অধ্যায়ের সূচনা, যে অধ্যায়ের পরতে পরতে লেখা আত্মার আত্মীয়তার কথা!
মৃত্যুহীন মহাজগতের মর্মভেদী কর্ম সাধনায় তিনি আজো অতি সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করেন। যুগের পর যুগ এ যাত্রার ধ্বনি স্মৃতিপটে চিহ্ন একে যায়। পায়ে চলা থেকে শুরু করে তিনি আকাশ পথেও পাড়ি দেন অতি সাধারণের মতন, তাঁর সত্য দর্শনের ত্যাগ সাধনা মনে করিয়ে দেয় মহা মানবদের কথা। ভোজন বিলাসিতা স্পর্শ করতে সক্ষম হয় নি কখনো তাকে, এখনো কলাম লিখনে উঠে আসে তাঁর পান্তা, পেঁয়াজের কথা, সাপ্তাহিক হিসেবের তালিকায় এক দু’টুকরো মাছ, মাংসের কথা, মানবতার ক্রন্দনে ক্রন্দিত গুনী খাবার মুখে তুলতে সহস্রবার ভাবেন ক্ষুধার্ত মানুষের কথা! তিনি বারবার চিৎকার করে বলতে চান মানুষের তরে মানুষের পরম আনন্দ নিহিত! আনন্দময় এ মহান মানব আজো পহেলা বৈশাখে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেন সহায় সম্বলহীন জীবন সংগ্রামী মহা সাধক কিষাণ, চাষিদের কথা!
বিশ্বাসের গভীর আলিঙ্গনে খুঁজে ফেরেন তিনি মানব প্রীতির আকুলতা, ব্যাকুলতাময় সান্নিধ্যের ছোঁয়া! অদেখা অচেতনের পূজন ছেড়ে চৈতন্যে, জাগরণে জাগার আহ্বান করে চলেন তিনি নিরন্তর, সেই সে অন্তর্দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে গুপ্ত ধনের সন্ধান যেন অঙ্কিত হয়ে রয়ে যায়, অনুসন্ধানী মন ও মানব অতি যতনে তাঁরে বরণ করে নেন। প্রেম পিয়াসে তাই তো এমন করে তারই বলা সাজে….
“ও তুই/সামনে পেয়ে মানুষ রতন
ভক্তি যতন করলি নারে
মানুষ রতন ছাড়া কি ধন মিলতে পারে।।”
জাতি সত্ত্বার মুক্তির চেতনায় তারুণ্যময় চিরচঞ্চল দুরন্ত সে হাত কখনো থেমে থাকেনি, ও হাতের আখরে আখরে লেখা দেশ ও দশের মহান আন্দোলনের কথা, পূর্ব বাংলা থেকে উনিশ আটচল্লিশের অমর কথা, আটচল্লিশ থেকে বাহান্নর রক্ত ক্ষয়ী জাগরণের মুখরিত ধ্বনি, বাহান্ন থেকে একাত্তুর, একাত্তুর থেকে সম্প্রতির রূপরেখার কথোপকথনের মালা লিখনের স্লোগানে জ্বলে ওঠা যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র….
তিমির অন্ধকার ধেয়ে তাই বুঝি বলে উঠেন কবি –
“রক্তেরি পথ চেয়ে
আমরা হেঁটেছি জাতি সত্ত্বার গান গেয়ে”
এমন আকুল করা প্রেমে ভরা মানবতাবোধি মানুষ না জানি কত কি সাধনায় মেলে, মানুষ তো নয় যেন রতনের মূর্ত প্রতীক, যে রতনের চমকে চমকে জ্বলে উঠে আলোর বিচ্ছুরণ, সে বিচ্ছুরণের ঝলকের ছটায় মহীয়ান কবি লিখে যান “কবিতার কথা” –
“ভূমিষ্ঠ হয়েই আমি জননীর সাথে কবিতার
বাহু লগ্নে হয়ে গেছি অনিবার্য ভাবে সেই কবে
আমি জানি আমার কণ্ঠ চেরা চিৎকার
যে বাতাস টেনে এনে ফুসফুসে ঢোকালো সরবে”
সর্বাঙ্গে আকুতিমাখা মায়াময় ধ্বনির মূর্ছনায় কালজয়ী কবি সুধায় বারে বারে, শুক্লা পক্ষ কৃষ্ণ পক্ষ ভেদ করে মূল লক্ষ্যের যাত্রী হতে ওহে মানব মানবী আর কত প্রহর তোমার এখনো বাকি ? প্রত্যাশার আলো জ্বেলে আমি পথ চেয়ে আছি, জাগো, জাগাও অন্তর চক্ষু, মোক্ষম উপাসনার নিমন্ত্রণ করে চলা বার্তা বাহক আমি, ঝড় ঝঞ্ঝাট আঁধারের পথ ঠেলে গহীন অজানাতে তোমাদের প্রতিক্ষায় নামি। অপার প্রেম আকাঙ্খি কবি আত্মার শান্তি কামনায় কখনো কখনো জিয়ন্তে মরণের পথ ধরে ব্যকুল আরাধনায় প্রেম ভিক্ষা মাঙ্গে….
“নতজানু হয়ে কানু
ভিক্ষা মাঙ্গে রাধার কাছে
হায়রে এমন প্রেম ভিক্ষারী আর কে আছে “
শুদ্ধতার পথচারী হয়ে তিনি সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যান, শুদ্ধতার আর্দশে গড়ে তুলতে অনুসন্ধানী, অনুসারীদের। চাকরিরত অবস্থায় কখনো রেডিওতে বসে, কখনো পত্রিকা, কখনো স্ব-শরীরি সাক্ষাৎকারে, কখনো রেস্টুরেন্টে বসে, কখনো নিজ গৃহে, কখনো পুস্তক, কখনো ফেসবুকের পাতায় মহান ব্রতী মহা মানব চেষ্টা করেন নব নব হাতে গান কাব্য রচনাকৌশল শুদ্ধতার দীক্ষার দীক্ষিত করতে, তাই বুঝি তিনি এমন করে বলে যান…
“অতীত থেকে অতীতে
চললে কালের গতিতে
পৌঁছে যাবো জানি সেই আদ্যে
প্রথম জাগা আলোতে
ফুটছিল রঙ কালোতে
সৃষ্টি দিনের আনন্দের /বাদ্যে॥”
দেশ প্রেমিক মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান সহজভাবে অল্প কথায় পুরো ভাবটা প্রকাশ করতে নিজে যেমন পারদর্শী তেমনি তিনি তাঁর ভক্তদের উৎসাহিত করেন, আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান ভেতরের আবেগকে নিজের সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারের দ্বারা শ্রেষ্ঠ ভাবে প্রকাশ করতে, তাঁর নিপুণ কাব্যের কাব্যিকতায় ফুটে উঠে স্বদেশ প্রেম নিখুঁতভাবে ….
“আমি /কেমন করে ভুলি
শিশির মাঠের শ্যামল খাতায়
বেতস লতায় চিরল পাতায়
ছড়ানো সেই দূর্বা সবুজ
কিশোরী দিনগুলি! “
অনিঃশেষ মানবতার মূর্ত কবি অন্ধকারে তীব্র আঘাত হানা প্রতিবাদী জ্যোতির্ময়ি এক প্রেমালোক, মমতা সমতার বাক্যালাপে সাজানো অলংকার, অলংকারের ঝংকারে ঝংকারে নেচে উঠা যেন এক কাল পুরুষ মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান মহাযোগের যুগল মিলনের মূর্ত প্রতীক।