প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আপনারা যারা সঙ্গীত ভালবাসেন তাদের জন্য এই লেখাটি আমাদের মতে অতি প্রয়োজনীয়। জেনে নিন দেশের এ সময়ের জনপ্রিয় শিল্পীসহোদর পার্থ মজুমদার এবং বাপ্পা মজুমদার এর বাবা সম্মানীত, শ্রদ্ধেয় শিল্পী ও ওস্তাদ বারীন মজুমদার সম্পর্কে স্মৃতিচারন করেছিলেন তাঁর স্ত্রী ইলা মজুমদার। না পড়লে বা না জানলে হয়তোবা তাদের ছেলেদের মূল্যায়ন করতেও আমরা ভুল করতে থাকবো বা করবো। ধন্যবাদ।
সহধর্মীনি ইলা মজুমদারের স্মৃতিচারনে বারীণ মজুমদার…
স্বামী হিসেবে তাঁর সম্পর্কে অনুভূতিঃ শ্রী বারীণ মজুমদার স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন-
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা হলে নিজের অতলে তলিয়ে খুঁজে দেখতে চেষ্টা করলাম। কোন স্মৃতি আছে কি না ?
শুধুই মনে হয় এমন স্নেহময়, প্রেমময়, সহানুভূতিসম্পন্ন স্বামী কি ঘরে ঘরে থাকে ?
বয়সের পার্থক্য একটু বেশী ছিল বলে মমতার স্পর্শটাই পেয়েছি বেশী করে। তাই বলে ভুল, অন্যায় বা অশোভন কিছু করতে দেখলে দু’টি চোখে শাসনের দৃষ্টি নিবারন করতেন। সেটিই নিরস্ত্র করত কোনো অসঙ্গত কাজ থেকে আমাকে। মুখে বকা-ঝোকা করা তাঁর শালীনতা ও রুচী বিরুদ্ধ ছিল।
তেজস্বী পুরুষ ছিলেন বলে তাঁর কথা বলা, আচার-আচরণে তা ঝড়ে পড়তো। কণ্ঠস্বর থেকে শুরু করে পদচারণা সবই দৃপ্ত পৌরুষে ভরা।
কোনো কাজ সে যত কঠিনই হোক না কেন একটুও দমতেন না, বরং কাজটি সম্পন্ন করে অজেয় কে জয় করার অদ্ভুত একটা আনন্দের ছ’টা চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত। ফিনফিনে ধূতি আর সাদা আদিকর পাঞ্জাবী ছিল তাঁর প্রিয় পোষাক। মুখে বলতেন “ঐ আদিকর পাঞ্জাবী” পড়বার জন্যেই তো শরীরটা তৈরী করতাম। বড় সুগঠিত দেহ ছিল তাঁর। এক বিন্দু মেদ নেই। বাইরে থেকে দেখে মনে হত বেশ রোগা মানুষটি। একবার আমার মাকে বড় মমতাভরে বলতে শুনেছিলাম “আহা বেচারা ঠিক মত খায় না বলেই শরীরের ঐ দশা”।
সে কথা শুনে মিটি মিটি হেসে আমাকে পরে বলেছিলেন “তোমার মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল জামাটা খুলে ফেলে আমার আসল শরীরটা দেখাব নাকি ?” ইত্যাদি। শরীর চর্চার কত যে কলাকৌশল জানা ছিল আর মনের মত কোনো ছেলের দেখা পেলেই তাকে ব্যায়ামের পাঠ দিতে শুরু করতেন। তাঁর ঐ এক কথা ছিল “স্বাস্থ্য না থাকলে আবার পুরুষ মানুষ কি ? কিন্তু ভবিতব্য এমন যে তাঁর নিজের দু’টি ছেলে বাবার এ আদেশ নির্দেশ শুনেও নিজেদের সুঠাম দেহের অধিকারী করে গড়ে তোলেনি। তাঁর শখের কথা বলতে গেলে একের পর এক কত বিষয় যে এসে পড়ে! ভালবাসতেন গান, ভালবাসতেন ফুল, ভালবাসতেন শিকার করতে, মাছ ধরতে, মোগলাই রান্না করতে, শাহী পান জর্দা খেতে।
মেজাজটি যেমন রাজকীয় সব কাজেই সেই রাজকীয়তা। সত্ব, রজঃ, তম এই তিন গুণের মধ্যে তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল ঐ রজঃ গুণ। বসবার ভঙ্গি থেকে শুরু করে তাকাবার ধরনেও এক ব্যতিক্রমী রাজকীয় সৌন্দর্য। স্বাধীনভাবে চলতে ভালবাসতেন। ভাবনার গতি প্রকৃতিও ছিল একেবারে মৌলিক, ভিন্ন মাত্রার। সাধারণ সবার মত নিশ্চিন্তে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার কথা জীবনের কোনো একটি দিনও ভেবেছেন বলে মনে হয় নি। যে জন্যে স্ত্রী, পুত্র পরিবারের নিশ্চিত ভবিষ্যতের ব্যবস্থা তিনি করে যেতে পারেন নি, হয়তো চানও নি।
প্রকৃতি পাগল, খেয়ালি এক মানুষ। শোকে, দুঃখে কাতর হতে দেখি নি। অসক্ত হয়ে পড়েও, মনের মধ্যে কত কিছু সৃষ্টির জল্পনা কল্পনা মনের মধ্যে নিত্য আনাগোনা করত। যা কিছুই করতেন অতি নিষ্ঠার সাথে নিখুঁত ভাবে। যেমন নিজের জামা কাপড় নিজে ধুঁয়ে নিখুঁত করে ইস্ত্রি করতেন। তাঁর প্রকৃতিগত ভাবেই তা আমরা যারা দেখেছি তারা ছাড়া বোঝা সম্ভব না, বোঝানো তো আরও অসম্ভব। বড় বড় কালো গোলাপ (Black Prince) তাঁর বড় প্রিয় ফুল, আর তারই সাথে night queen এবং দোলন চাঁপার প্রতিও গভীর অনুরাগ দেখেছি। যখন যেখানে থেকেছেন নিজের হাতে ফুল বাগান করা চাই-ই চাই। যাই করবেন তাই বড় পরিপাটি করে। অনুষঙ্গ তার আয়োজনের সে এক মহাসমারোহ।
সব চাইতে ভালবাসার বস্তু ছিল তাঁর “সুগন্ধি” (সেন্ট বা পারফিউম)। ওটি না হলে যেন তার চলেই না। “My sin” নামের একটা পারফিউম বড় ভালবাসতেন। “কার্পন্য” শব্দের সঙ্গে যার কোন যোগ নেই সেই মানুষটিকেও দেখেছি ঐ বিশেষ সুগন্ধিটা ব্যবহার করতেন যেন একটু হিসেব করেই। ওটি যে চাইলেই তখন পাওয়া যেত না। দেহ মনের অসহ্য যাতনা সহ্য করতেন একেবারে নীরবে। কষ্ট সহ্য করবার শক্তি কত থাকতে পারে একটি মানুষের মাঝে তারও যেন তিনি উদাহরণ। বিন্দুমাত্র অসম্মানের আভাসেও এই মানুষটি react করতেন ভয়ঙ্কর ভাবে। কিন্তু এই একটি বিষয়ে তিনি এত স্পর্শ কাতর ছিলেন যে সেটা সামাল দেওয়াই ছিল সব চাইতে কঠিন।
কঠোর আর কোমলের এক অদ্ভুত সমস্বর ছিল মানুষটির মাঝে। বাইরে থেকে দেখতে যাঁকে অত অজেয় বলে মনে হত একটু স্নেহ ভালবাসা আর অন্তরের স্পর্শ পেলে একেবারে শিশুর মত সহজ আর সরল। পৃথিবীর সাধারণ নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সব সময় পারতেন না। মনের সায় না পেলে একেবারে নিজের মাঝে ডুবে থাকতেন। স্বভাবটা একেবারে চরমভাবাপন্ন। যা করবেন সেটাই চূড়ান্ত পর্যায়ের। এখানেই হত অসুবিধে। নিচের ইচ্ছের বিরুদ্ধে “বাহ্যিক ভদ্রতা” ভনিতা করা তার স্বভাবে ছিল না। তাই সবার সাথে খাপ খাওয়াতে বুঝে বা পেরে উঠতেন না। বেহিসেবি মানুষ ছিলেন বলেই পৃথিবীর হিসাবে হিসাব মেলাতে পারেন নি। যত্র আয়, তত্র ব্যায়। মিথ্যাচার, শঠতা, কার্পন্য, শিষ্টাচার বহির্ভুত জিনিষ সইতে পারতেন না। সুন্দরের অনুরাগী এক মুক্ত পুরুষ। সুরের সঙ্গে রঙের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর অদ্ভুত একটা চিন্তা ছিল সেই ৫০ বছর আগে থেকে। ভালবাসতেন সবাইকে নিয়ে আনন্দ করতে, খেতে নয়, খাওয়াতে। নিজে ছিলেন অতি স্বপ্নহারি।
কিন্তু প্রতিটি খাদ্যবস্তুর স্বাদ গন্ধ মনের মতো না হলে স্পর্শও করতেন না। এত নির্লোভ এবং পর দুঃখে কাতর একটা মন তাঁর মাঝে ছিল যা আমি ভাল করে জানতাম। তিনি বলতেন “প্রতিটা স্বরের এক একটা রঙ আছে এবং এক স্বরের সঙ্গে আর এক স্বরের সমন্বয়ে বর্ণেরও পার্থক্য ঘটে। এই বিষয়টি গানের পাশাপাশি পর্দায় বর্ণের যে বৈচিত্র ঘটতে পারে এটা বাস্তবে ঘটিয়ে দেখাবার যদি কোনো সুযোগ পাওয়া যায় – এ নিয়ে নিজে তো ভেবেই মরতেন আর সন্ধান করতেন তেমন বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিত্বের যিনি তাঁর ভাবনার বাস্তব রূপে ঘটিয়ে মানুষকে মুগ্ধ তদগত করতে পারে। হয়তো বা এরকম ঘটনা কখনো ঘটবে কিন্তু তিনি তা প্রত্যক্ষ করতে পারলেন না। এক অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই বলে যেতে হল তাঁকে।