– মোশারফ হোসেন মুন্না।
পার্থ মজুমদার ও বাপ্পা মজুমদার দুই ভাই। দুজনই গানের মানুষ। ছোট ভাই জনপ্রিয় শিল্পী। বড় ভাই নিভৃতচারী। তবে, বাপ্পার গুরু তাঁর দাদা। দু’জনে কাজ করেন দুটি আলাদা সঙ্গীত দলে। দলছুট আর ধ্রুবতারা। আজ পার্থ মজুমদার ও বাপ্পা মজুমদারের বাবা বারীণ মজুমদারের মৃত্যুবার্ষিকী। বাপ্পার সাথে এ নিয়ে কথা হলে তিনি জানান যে, বারীণ মজুদার একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন বটে কিন্তু তাকে কেউ মনে রাখেনি। তার জন্ম মৃত্যু নিয়ে
কারো কোন সময় নেই কিছু করার। কোন টেলিভিশন চ্যানেল তাকে নিয়ে কোন অনুষ্ঠান করে না। সত্যি বলতে যারা চলে যায় তারা প্রয়াত। তাদেরকে কেউ মনে রাখতে চায় না, আর রাখবেই বা কেন ? কি দিতে পারবে আর বারীণ মজুমদার ? আমরা ঘরোয়া ভাবে নিজেরাই পালন করি। আমরাতো আর আমাদের জন্মদাতার কথা ভুলে যেতে পারি না। বাপ্পা মজুমদারের কথাগুলো সত্যিই বাস্তব। আমাদের দেশের সঙ্গীত ভূবনের অনেক সঙ্গীত তারকা কিংবদন্তী পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন তার মধ্যে বারীণ মজুমদার একজন। তাদের জীবনটাই সঙ্গীতের নামে উৎসর্গ করে গেলেন অথচ তাদেরকে ভুলে যায় সঙ্গীত ভূবনে এখনো বেচেঁ থাকা মানুষগুলো। একদিন এমন হয়তো হবে যারা এখন বেচেঁ আছেন তারা চলে যাবার পর তাদেরকেও এমনি ভাবে ভুলে যাবে তাদের রেখে যাওয়া সঙ্গীতের মানুষগুলো। তাই সবার এ বিষয়ে একটু গভীর চিন্তা করা দরকার যেন, সঙ্গীতাঙ্গনের কোন মুখ পৃথিবী থেকে একবারে বিলীন হয়ে না যায়। তারা যেন বেচেঁ থাকে তাদের কর্ম ও ভালোবাসার মাঝে।
বাবার মৃত্যুবার্ষিকীরর দিনে বড় ছেলে পার্থ মজুমদারেরর সাথে আলোচনায় জানা যায় অতীত হয়ে যাওয়া স্মৃতি কথাগুলো। যার মাঝে লুকিয়ে আছে আনন্দ ও বেদনার স্মৃতি। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতসাধক পণ্ডিত আমার বাবা বারীন মজুমদার আমাকে ডেকে বললেন, চলো হাসপাতালে যাই। তোমার একটি ভাই হয়েছে। মাকে আর ভাইকে আনতে বাবার সঙ্গে হাসপাতালে গেলাম তখন আমার বয়স আট বছর।
অনেক দিন পর আজও পার্থ মজুমদারের মনে পড়ে, দিনটি ছিল অসম্ভব আনন্দের। কারণ, মাত্র ১১ মাস আগে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ত্রাস রাজত্ব ঢাকা শহর ছেড়ে পালানোর সময় বুড়িগঙ্গা নদীতে গানবোট থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় পণ্ডিত বারীন মজুমদার ও ইলা মজুমদারের বড় মেয়ে ১০ বছর বয়সী মধুমিতা। সেই শোক প্রশমনের জন্যই বাপ্পার জন্ম বলে জানান পার্থ মজুমদার। বাবা ও মায়ের প্রভাব তাদের জীবনে কি প্রতিফলন ঘটেছে সে প্রশ্নের জবাবে পার্থ মজুমদার বলেন, জীবনের সব ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রভাব আছে। তাঁদের সন্তান বলেই পার্থ মজুমদার না হয়ে আমার আর অন্য কিছু হওয়ার উপায় ছিল না।
ঘরে সময় কাটতো গানে। অবসরেও গান। স্নানের সময়ও গান। কিন্তু শুরুর দিকে মা-বাবা সঙ্গীতটা চাপিয়ে দেননি জোর করে। আমাদের পারিবারিক জীবনে কোনো অসৎ উপার্জন ছিল না। ‘অসৎ’- কথাটা কখনো শিখি নি। মা-বাবা শেখান নি। পণ্ডিত বারীন মজুমদার এ দেশে মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে সব করতে গিয়ে নিজের সাধনা ব্যাহত হয়েছে তাঁর। অসম্মানিতও হয়েছেন কুচক্রী মহলের অপচেষ্টায়। তারপরও এই সঙ্গীতকেই কেন বেছে নিলেন ? জবাবে বলেন, কোনো ধরনের কষ্টের কথা আমরা বুঝতে পারতাম না। কারণ, মা-বাবা কখনো তা বুঝতে দেননি। দিদির জন্য মা সারাক্ষণ কাঁদতেন। অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সেই কষ্ট কাটানোর জন্য বাপ্পার জন্ম। বাপ্পা বাবার বুকে ঘুমোত। ওকে বুকে নিয়েই বাবা তানপুরায় সুরসাধনা করতেন। তালগুলো নিশ্চয়ই বাপ্পার কানে ঢুকে যেত। চার বছর বয়সী বাপ্পা একদিন গেয়ে ফেলল- ‘আমার দীপ নেভানো রাত’ গানটি। আমাদের আরও একজন দাদা পার্থ প্রতিম মজুমদার। বাবা-মার পালকপুত্র। বাসায় কিশোর কুমার, ভূপেন হাজারিকার গান আনতেন। বাবা তখন থেকে শেখানো শুরু করলেন। তবলা বাজাতাম, কিন্তু লয় বেড়ে যেত। আমি ফাইটার প্লেনের পাইলট হতে চেয়েছিলাম। বাবাও রাজি ছিলেন। কিন্তু আমার দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল ছিল তাই আর হলো না। আমার ছোট ভাই বাপ্পা তার স্বপ্ন ছিলো স্থপতি হবে। কিন্তু লেখাপড়ায় ছিল মহা ফাঁকিবাজ। তাই রেজাল্ট ভালো হয় নি। তখন গিটার নিয়ে মেতে উঠেছে। তার গিটারগুরু কিন্তু ছিলাম আমি নিজেই। পার্থ মজুমদার জানায়- বাবা বলতেন, তোমার মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য আমরা বাপ্পাকে এনেছি। নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা দিদির কিছু জিনিসপত্র আগলে রাখতেন – ফ্রক, পুঁতির মালা, পুতুল। যে দিন এসব নাড়াচাড়া করতেন, সেদিন মায়ের মুখের দিকে তাকানো যেত না। বাপ্পার জন্মের কারণে দিদিকে হারানোর কষ্টটা মা, বাবা ও দাদা খানিকটা ভুলতে পেরেছিলেন। বাপ্পা আমার বুকের ভেতরে থাকে। এটা বলে বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই।
বাপ্পার তিনজন অসাধারণ মানুষের একজন হলাম আমি। অনেক আগে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। একসঙ্গে সঙ্গীতায়োজনের কাজ হয়েছে। আর একসঙ্গে ব্যান্ড না করাটা হলো একটা জেনারেশন গ্যাপের কারণে। আর্ক বানালাম। বামবা’য় থাকলাম। টুটুল এসে বলল, দাদা, ‘ধ্রুবতারা’য় আমাকে সহযোগিতা করুন, সেখানে থাকলাম এই আর কি। তবে এভাবেই থাকতে চাই দুই ভাই বাকি জীবন। সবার দোয়া কামনা করি। এবং আমার বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই, ঈশ্বর যেন তাকে সুখে রাখেন। সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে বারীণ মজুমদারকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা জানাই।