– মোশারফ হোসেন মুন্না।
‘নাম গুম জায়েগা, চেহরা ইয়ে বদল জায়েগা, মেরি আওয়াজ হি পেহচান হ্যায়, গর ইয়াদ রহে’- ১৯৭৭ সালে গুলজারের লেখা ও লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া কিনারা ছবির এই গানের প্রত্যেকটি শব্দই যেন ভারতীয় সঙ্গীতের অন্যতম কিংবদন্তির কথাই বলে। যেন মনে হয় এই গান হল মেলোডি কুইনের উদ্দেশে লেখা গুলজারের প্রেমপত্র। ৯০ বছরে পা দিলেন লতা মঙ্গেশকর। ভারতীয় শ্রোতাদের তাঁকে আলাদা করে মনে রাখতে হবে না। যতদিন বলিউড মিউজিক জীবিত থাকবে মানুষের স্মৃতিতে, ততদিন তাঁর কণ্ঠের হাজারেরও বেশি গান নিয়ে তিনি বলিউড মিউজিকেরই আর এক নাম হয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। তিনিই বলিউড সঙ্গীত, সর্বতোভাবে, ভালো, মন্দ সবটুকু নিয়েই। ভারতরত্ন সঙ্গীতশিল্পীর সাঙ্গিতীক যাত্রাও অনন্য সাধারণ। মারাঠি থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের মেয়ে লতার জন্ম ১৯২৯ সালে। সঙ্গীত ও অভিনয় দুই-ই তাঁর রক্তে। কিন্তু অসামান্য প্রতিভার আলয় হয়েও মঙ্গেশকর পরিবারের দিন কাটত অত্যন্ত দারিদ্রে। ‘সে বাড়িতে সিনেমার গান খুব একটা আদৃত ছিল না’, একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সম্রাজ্ঞী, ‘আমার বাবা খুবই রক্ষণশীল মানুষ ছিলেন। আমাদের সাজপোশাক নিয়েও খুব কড়া মনোভাব ছিল তাঁর। আমরা কখনও পাউডার বা মেকআপ ব্যবহার করতাম না। ইচ্ছামতো বাইরে যাওয়ারও অনুমতি ছিল না। বেশি রাত করে নাটক দেখে ফেরা পছন্দ করতেন না বাবা, এমনকী নিজেদের প্রযোজনা হলেও নয়।’
খুব ছোট থেকেই তিনি মন দিয়ে মুগ্ধ হয়ে রেডিওতে সায়গলের গান শুনতেন। সেই থেকে নিজের ভেতর স্বপ্নে বীজ বোনা শুরু। তার নিজের বড় সাধ ছিল- একদিন বড় শিল্পী হয়ে সায়গলের পাশে দাঁড়িয়ে ডুয়েট গাইবেন। নিজের আয়ে প্রথম রেডিও কিনলেন। চালিয়ে দিয়ে ভাবছেন বহুদিন পর একটু শান্তিতে বসে সায়গলজীর গান শুনবেন।
একটু পরেই শুরু হলো খবর। সেই খবরে শুনতে পেলেন – কুন্দন লাল সায়গল আর বেঁচে নেই! সেই কষ্ট সইতে পারেননি। কাঁদতে কাঁদতে ‘অপয়া’ রেডিয়োটাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন দোকানে। জীবদ্দশায় তার বাবাও নাকি প্রায়ই একে-ওকে বলতেন, ‘দেখো, আমার বড় মেয়ে একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।’ – সত্যি তাই হয়েছে। শুধু বড় শিল্পীই নন, হয়েছেন সেরাদের সেরা, কিংবদন্তি।
বলছি, এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কথা। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় এই সুর-সম্রাজ্ঞী ৯০তম জন্মদিন। এবার ৯১ বছরে পা রাখলেন গানের পাখি লতাজি। কিংবদন্তি এই সঙ্গীতশিল্পীর ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভারত সরকার আজ এই কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পীকে ‘ডটার অব দ্য ন্যাশন’ উপাধিতে ভূষিত করবে। গত আট দশক ধরে ভারতীয় সঙ্গীত জগতে কাজ করছেন তিনি।
মধুবালা থেকে কাজল পর্যন্ত শত নায়িকার ঠোঁটে শোনা যায় তাঁর গান। এক অবারিত সুরের জাদুতে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন উপমহাদেশের সর্বস্তরের মানুষকে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গান ও সুরের ইন্দ্রজালে কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছেন তিনি।
শুধু ভারতই নয় সমগ্র উপমহাদেশে লতা মঙ্গেশকর আর দ্বিতীয়টি নেই। যার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। তাঁর সঙ্গীত ভারত ছাপিয়ে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বসঙ্গীতের দরবারে। শুধু বাংলা বা হিন্দিতেই নয়, বহুভাষায় সুরের মোহ ছড়িয়েছেন অগণিত মানুষের মনের মনোজগতে।
যেন বিশ্বসঙ্গীতে সুরের ইন্দ্রজাল বিছিয়েছেন গানের পাখি লতা মঙ্গেশকর। লতাজীর কীর্তি বলে শেষ করা যাবে না। ভীরজারার পরিচালক যশ চোপড়া বাকি শিল্পীদের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের পার্থক্য রেখা টানতে গিয়ে বলেছেন, ‘সব শিল্পী সঙ্গীতকে অনুসরণ করে, আর সঙ্গীত অনুসরণ করে লতাকে।’
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতিপ্রেমী মধ্যবিত্ত মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লতা। পণ্ডিত দিনানাথ মঙ্গেশকরের বড় মেয়ে লতার জন্ম মধ্য প্রদেশের ইন্দোরে। প্রথমে লতার নাম রাখা হয় ‘হেমা’। জন্মের পাঁচ বছর পর তার নাম বদলে রাখা হয় লতা। মা শেবন্তী ছিলেন গৃহিণী। লতার তিন বোন আশা ভোঁসলে, ঊষা মঙ্গেশকর, মীনা মঙ্গেশকর এবং ছোট ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। ভাইবোনদের মধ্যে লতা সবার বড়।
বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী এবং মঞ্চাভিনেতা। বাবার কাছে হাতেখড়ি হওয়ার পর ওস্তাদ আমানত আলী খাঁ সাহেবের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা হয় তাঁর। তার বেড়ে ওঠাটা মহারাষ্ট্রেই। সাত বছর বয়সে এই শহরে পৌঁছান ভারতের এই সুর সম্রাজ্ঞী। পাঁচ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মঞ্চে অভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি শৈশব থেকেই গায়িকা হতে চেয়েছিলেন। পিতা ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুরাগী। ১৯৪২ সালে বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ১৩ বছর বয়সী লতাকে পরিবারের আয়ের জন্য হাল ধরতে হয়। প্রথমবার মঞ্চে গান গেয়ে লতা ২৫ টাকা পারিশ্রমিক পান। এটাই তার জীবনের প্রথম উপার্জন।
লতা মারাঠি ও হিন্দি চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পীর ভূমিকায় কাজ শুরু করেন। ১৯৪২ সালে প্রথমবার মারাঠা চলচ্চিত্র ‘কিতী হাসাল’- এর জন্য গান গেয়েছিলেন সঙ্গীতের এই চিরকুমারী। দুঃখজনক ঘটনা হলো, চূড়ান্ত সম্পাদনায় বাদ দেওয়া হয় ‘নাচু ইয়া গাদে, খেলু সারি মানি হাউস ভারি’ কথার গানটি।
বাবা মারা যাওয়ার পর ওস্তাদ আমানত আলীর বন্ধু সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের শরণাপন্ন হলেন লতা। কিন্তু উপকার করতে গিয়ে গুলাম হায়দার পড়লেন অস্বস্তিতে। বড় আশা করে শশধর মুখার্জির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু লতার কণ্ঠ শুনে শশধর মুখার্জি বললেন, ‘একে এনেছেন কেন ? এর কণ্ঠ কোনো নায়িকার সঙ্গেই মিলবে না। আর যা-ই বলুন, এই মেয়ের যা কণ্ঠ তা দিয়ে প্লেব্যাক হবে না।’
আর কেউ হলে হয়তো হতাশায় ভেঙে পড়তো। কিন্তু না, হাল ছাড়েননি লতা। গুলাম হায়দার সেদিন লতাকে সাহস দিয়ে জোর গলায় সবাইকে বলেছিলেন, ‘আমি বলছি, এই মেয়ে কিছুদিনের মধ্যে নূরজাহানকেও ম্লান করে দেবে, প্রযোজক-পরিচালকরা তখন তার পেছনেই ছুটবে।’
সেদিন লতাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন গুলাম হায়দার। গোরেগাঁও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গুলাম হায়দার শশধর মুখার্জিকে শোনানো সেই গান আবার শুনতে চাইলেন লতার কাছে। ততক্ষণে ট্রেনও এসে গেছে। ট্রেনে উঠেই ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ আর যাত্রী-ফেরিওয়ালাদের চেঁচামেচির মাঝেই গান ধরলেন লতা।
সিগারেটের টিনে তাল ঠুকতে ঠুকতে গান শুনলেন গুলাম হায়দার। মুখে কিছু বললেন না। ট্রেন থেকে নামিয়ে লতাকে সোজা নিয়ে গেলেন মালাদ-এর বোম্বে টকিজ স্টুডিয়োতে। কী আশ্চর্য, সেখানে লতা প্রশংসিত এবং মজবুর ছবিতে গাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন! হুসেইন লাল ভগতরাম, অনিল বিশ্বাস, নওশাদ এবং খেমচান্দ প্রকাশ- ভারতীয় সঙ্গীতের এমন চার দিকপালের সামনে গুণে গুণে ৩২ বার একটা গান গাইলেন লতা, রেকর্ডিং হলো তারপর।
সেই যে পায়ের নিচে শক্ত একটুখানি মাটি পেলেন তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ভারতের প্রধান সুরকারদের প্রায় সবার সঙ্গেই কাজ করেছেন এবং প্রায় সব ধরণের গানই করেছেন।
১৯৪৮ সালে ‘মজবুর’ ছবিতে প্রথম বড় সুযোগ পান লতা মঙ্গেশকর। এ ছবিতে ‘দিল মেরা তোড়া’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছিলেন তিনি। তবে তার প্রথম তুমুল জনপ্রিয় গান হলো ‘মহল’ (১৯৪৯) ছবির ‘আয়েগা আনেওয়ালা’।
এতে অভিনয় করেন প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেত্রী মধুবালা। পঞ্চাশের দশকে হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন লতা মঙ্গেশকর। সেই থেকে তার ক্যারিয়ারের যোগ হতে থাকে একের পর এক কালজয়ী গান। তবে পঞ্চাশের দশকে শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে দ্বৈরথের কারণে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তারা একসঙ্গে কাজ করেননি। শচীন দেব বর্মণের পুত্র রাহুল দেব বর্মণের সুরে অনেক গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯৭২ সালে ‘পরিচয়’ ছবির ‘বীতি না বিতাই’। এই গানটির জন্য ১৯৭৩ সালে সেরা গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। ১৯৯০ সালে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়েন লতা মঙ্গেশকর। তার প্রযোজনায় গুলজারের পরিচালনায় ১৯৯০ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘লেকিন’। এতে ‘ইয়ারা সিলি সিলি’ গানের জন্য তৃতীয়বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান লতা। এটি সুর করেন তার ছোট ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে রোমান্টিক গান, এমনকি ভজনও গেয়েছেন তিনি। লতা মুঙ্গেশকর প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন। এর মধ্যে আছে বাংলাও। ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বেলে’সহ আরো অনেক কালজয়ী বাংলা গানের কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। ১৯৭৪ সালে সবচেয়ে বেশি গানের শিল্পী হিসেবে গিনেস বুকে স্থান পান লতা মঙ্গেশকর। নব্বই দশকে এ আর রাহমান ও প্রয়াত গজল সম্রাট জগজিৎ সিংয়ের সঙ্গে কাজ করেছেন লতা মঙ্গেশকর। প্রয়াত যশ চোপড়ার প্রায় সব ছবির গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। গান গেয়ে অনেক সুনাম ও সম্মান অর্জন করেছেন লতা মঙ্গেশকর। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ লতা মঙ্গেশকর ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে পদ্মবিভূষণ, ১৯৯৯ সালে এনটিআর জাতীয় পুরস্কার, ২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেছেন। পাশাপাশি তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চারবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ১২বার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার পেয়েছেন নন্দিত এই সঙ্গীতশিল্পী। প্রখ্যাত এ শিল্পীকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘অফিসার দো লা দি’ অনার প্রদান করেছে সে দেশের সরকার।
এছাড়াও তিনি দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
৯১ বছর বয়সেও তার জাদুকরী গায়কি নিয়ে সঙ্গীতজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই রয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। তিনি আরও অনেকদিন বেঁচে থেকে তার ভক্তদেরকে সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ করবেন এটাই সবার প্রত্যাশা।