– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
কোনো রাজনৈতিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা দেখতে পাই, রাস্তাঘাটে মিটিং, মিছিল, ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার মত কর্মকাণ্ড চলে কিন্তু সংস্কৃতিক অঙ্গনে দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য রাস্তায় নামার প্রয়োজন হয় না! তার জন্য রুদ্ধদ্বার বৈঠকই যথেষ্ট। সঙ্গীত ভূবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষেরা তাঁদের নিজস্ব সৃষ্টির মাধ্যমে যুগের পর যুগ মানুষের মনের খোরাক মিটিয়ে আসছে। তেমনি তাঁরা থেমে থাকে না দেশের দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতেও। যেমন আমরা দেখি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গীতিকারের ধারালো কলমের খোঁচায়, সুরকারের অপূর্ব সুর এবং শিল্পীদের বজ্রকন্ঠের কারণে মুক্তিযোদ্ধাগণ যুদ্ধক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন যেমন, তেমনি ক্রিকেট খেলায়ও গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীবৃন্দ গান সৃষ্টি করে খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন খেলার মাঠে। তারপর বন্যা ও দেশের বিভিন্ন দিবসে তাঁদের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন গান, তা আমরা জানি। আজকে এত কথা লেখার একটিই কারণ তা হচ্ছে, সঙ্গীতাঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ এই যে, নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দেশের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য অথচ তাঁরা কি তাঁদের ন্যায্য সম্মানী বা অধিকার পাচ্ছেন ? নাহ! পাচ্ছেন না। তাই আজ সোচ্চার হয়েছেন সঙ্গীতাঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সকল কলাকুশলী-গীতিকার,সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং শিল্পীবৃন্দ তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। আর সেই সুত্র ধরে গঠন হয়েছে বিভিন্ন সংগঠন যা কিনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় নি। অথচ বছরের পর বছর স্বনামধন্য অনেক গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পীবৃন্দ তাদের প্রাপ্য সম্মানী থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং অনেকেই না ফেরার দেশে চলেও গেছেন।
আমরা জানি যে, চলতি বছরের জুন মাসের শেষের দিকে কপিরাইট আইন অমান্যের কারণ দেখিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৩ ধারায় দেশের জনপ্রিয় নায়ক ও প্রযোজক শাকিব খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন জনপ্রিয় শিল্পী দিলরুবা খান। অভিযোগে একটি মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের পাঁচ কর্মকর্তার নামও রয়েছে। দিলরুবা খানের গাওয়া ‘পাগল মন’ গানের কিছু অংশ হুবুহু শাকিব খান প্রযোজিত ছবি ‘পাসওয়ার্ড’ ছবিতে ব্যবহার করায় এবং বাণিজ্যিক মোবাইলের ইন্টারনেট প্যাকেজে অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করায় এই অভিযোগ করা হয়েছে। যেখানে কপিরাইট আইন ভঙ্গের কারণে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ দাবি করা হয়েছে। দিলরুবা খানের অভিযোগ, শাকিব খান তার প্রযোজিত ছবিতে গানের কিছু অংশ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কোনো অনুমতি নেন নি। তেমনি কয়েক বছর আগে দেশের চার মোবাইল সেবাদান প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরণের অভিযোগ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সঙ্গীতশিল্পী প্রিতম আহমেদ। এছাড়া শিল্পীরা প্রায় সময়ই মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ এবং রয়্যালিটি আদায় যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন। তবে এসব অভিযোগের সুরাহা করতে শিল্পীদের পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বা অভিযোগ করতে দেখা যায় নি। কিন্তু করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে হঠাৎ করেই সঙ্গীতাঙ্গনে বিভিন্ন অরাজকতা নির্মূল করার লক্ষ্যে গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পীবৃন্দ বিভিন্ন সংগঠন গঠন করেছেন।
সম্প্রতি কপিরাইট আইন সংশোধনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে চিঠি দিয়েছেন, ‘গীতিকবি সংঘ বাংলাদেশ’। যে চিঠিতে রয়েছে সঙ্গীতাঙ্গনের সকল ক্ষেত্রের মানুষের জন্য ১০টি দাবি আদায়ের প্রস্তাবনা।
২৩ আগস্ট রবিবার ২০২০, সন্ধ্যায় কপিরাইট রেজিস্টার জাফর রাজা চৌধুরীর সাথে ‘গীতিকবি সংঘ, বাংলাদেশ’ সমন্বয় কমিটির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং চিঠি হস্তান্তর করেন। সেই প্রতিনিধিদলে ছিলেন দেশের চারজন জনপ্রিয় গীতিকবি- হাসান মতিউর রহমান, আসিফ ইকবাল, কবির বকুল এবং জুলফিকার রাসেল। তাঁরা কপিরাইট আইনে গীতিকবিসহ, সব সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, প্রযোজক ও মিউজিক লেবেলের ন্যায্য দাবি আদায়ের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেন। সেই সাথে তাঁরা জানান, এই ১০টি প্রস্তাবনা সংশোধিত কপিরাইট আইনে প্রতিফলিত না হলে সঙ্গীতাঙ্গনে ফিরবে না শৃঙ্খলা এবং ধ্বংস হবে না অরাজকতা। অন্যদিকে কপিরাইট রেজিস্টার জাফর রাজা চৌধুরী কপিরাইট আইন নিয়ে গীতিকবি সংঘের এমন আগ্রহ দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং সঙ্গীতাঙ্গনে গীতিকবিসহ সবার সর্বোপরি স্বার্থ নিশ্চিন্তকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখার সবরকম প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
এদিকে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ এবং রয়্যালটি আদায়ের লক্ষ্যে নতুন সদস্য নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে সঙ্গীতের সিএমও (কালেক্টিভ ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশন) বিএলসিপিএস। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম সদস্য হামিন আহমেদ। তিনি আরো জানান, ২২ আগস্ট ২০২০, থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিন বিকেল ৪টায় সংগঠনটির গুলশান কার্যালয়ে বসেছিল গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও ব্যান্ড দল নিয়ে সাধারণ বৈঠক। এই বৈঠক থেকেই সংগঠনটির নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যক্রমের প্রথম দিনে ফিডব্যাক, ওয়ারফেজ, সোলস, পেন্টাগন, লালন, আর্টসেল, শূন্য, পাওয়ার সার্জ, ট্রেইনরেক, পরাহ, ওনড,
দৃক ব্যান্ডগুলো নিবন্ধন করেন। এই সময়ে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএলসিপিএসের বর্তমান সদস্য ফুয়াদ নাসের বাবু, হামিন আহমেদ ও মানাম আহমেদ। করোনার পরিস্থিতির কারণে ঐ সভায় ভার্চুয়ালই যুক্ত হন সংগঠনটির চেয়ারম্যান সাবিনা ইয়াসমিনসহ, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক শেখ সাদী খান, ও কণ্ঠশিল্পী সুজিত মোস্তফা। সরাসরি এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- পার্থ বড়ুয়া, বাপ্পা মজুমদার, সঙ্গীত পরিচালক শওকত ইমন, নাভেদ পারভেজ, কণ্ঠশিল্পী পারভেজ সাজ্জাদ প্রমুখ। এই সভায় বিএলসিপিএসের আইনি পরামর্শক ব্যারিস্টার এ বি এম হামিদুল মিসবাহ এই সময় নতুন নিবন্ধিত সদস্যদের সদস্যভুক্তির বিভিন্ন উপকারিতা এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।
গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের ন্যায্য অধিকার আদায় ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্য রয়্যালটি সংগ্রহ ও বন্টনে বিএলসিপিএস সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে প্রতিক্রিয়া জানান সংগঠনটির অন্যতম সদস্য মাইলস লিডার ও বামবা’র সভাপতি হামিন আহমেদ। বাংলাদেশের গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের সিএমও হিসেবে বিএলসিপিএস (বাংলাদেশ লিরিসিস্ট, কম্পোজার অ্যান্ড পারফর্মারস সোসাইটি) সরকারি অনুমোদন পায় ২০১৪ সালে।
আশা করি, সংগঠনগুলো সঙ্গীতজগতের অরাজকতা দূর করার যে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছেন তা বাস্তবায়িত করে, সঙ্গীতাঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবেন। সঙ্গীতাঙ্গন পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল সংগঠনের জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা।