– মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না।
“কৃত্তিমানের মৃত্যু নাই, গুরুরা বলে গেছেন আসলেই সত্যি। মানুষ মৃত্যুবরণ করবেই এটাই যে নিয়ম। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বেচেঁ থাকে আজীবন। তাদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট সরদ বাদক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী।
উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর, ত্রিপুরা-র শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলাউদ্দিন খান নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। সেতার ও সানাই এবং রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসাবে সারা বিশ্বে তিনি প্রখ্যাত। যদিও সেতার আর সানাই বাদকে পারদর্শী ছিলেন মূলত সরোদই তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহন ছিল। সেক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেট সহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্রে তাঁর যোগ্যতা ছিল অপরিসীম। তাঁর সন্তান ওস্তাদ আলী আকবর খান ও অন্নপূর্ণা দেবী নিজস্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আচার্যের বিখ্যাত শিষ্যরা হলেন পণ্ডিত রবি শঙ্কর, পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জী, বসন্ত রায়, পান্নালাল ঘোষ সহ আরো অনেকে। আচার্য আলাউদ্দিন খাঁন সাহেব নিজেও অনেক বিখ্যাত গুরু হতে দীক্ষা নিয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কিংবদন্তিতুল্য ওস্তাদ ওয়াজির খান। ১৯৩৫ সালে বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন তিনি। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের রানী কর্তৃক সুরসম্র্রাট খেতাবপ্রাপ্ত হন। ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ ছাড়াও পদ্মবিভূষণ, বিশ্ব ভারতীয় দেশীকোত্তমসহ দিল্লি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি।
আলাউদ্দিনের ডাকনাম ছিল আলম। বাল্যকালে ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর নিকট সঙ্গীতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। সুরের সন্ধানে তিনি দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রাদলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। অতঃপর কলকাতা গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তবে গোপাল কৃষ্ণ একটি শর্তারোপ করলেন আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের সময় যে, কমপক্ষে ১২ বছর একনাগাড়ে সঙ্গীত সাধনা করতে হবে সেখানে থেকে। আলাউদ্দিন খাঁ রাজি হয়ে গেলেন আরোপিত শর্তে। কিন্তু সাত বছরের শেষ দিকে হঠাৎ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ। তার পর তিনি ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে তালিম নেন। পরে ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ রামপুরের নবাব হামেদ আলী খাঁর সঙ্গীত গুরু ছিলেন। তিনি তার কাছে দীর্ঘ ৩০ বছর সঙ্গীতের সুক্ষ্ণ কলাকৌশল আয়ত্ব করেন। তার সঙ্গীতের এই বিশেষত্ব দেখে মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ তাকে তার সঙ্গীত গুরু হিসেবে নিয়োগ দেন। এবং সেখানে তিনি স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। সেখান থেকেই শুরু হয় তার একের পর এক সুনাম অর্জনের যাত্রা। জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সাথে তিনি সফর শুরু করেন বিভিন্ন দেশে। শুরু হয় নানা দেশে তার প্রতিভার পরিচিতি। তার নিজ প্রতিভার গুণে সে সরোদ বাদনে ‘দিরি দিরি’ সুর ক্ষেপনের পদ্ধতি পরিবর্তন করে “দারা দারা” করেছেন। এবাবেই একের পর এক প্রবর্তনের জন্য অমর হয়ে আছেন না থেকেও। ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি সঙ্গীতের মোহ মায়া কাটিয়ে চলে যান পরপারে। আজ তার প্রয়াণ দিবস। সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে তার রুহের মাঘফেরাত কামনা করছি। আজীবন বেচেঁ থাকুক সঙ্গীতের অমর ইতিহাসের পাতায়।