asd
Friday, November 22, 2024

কোবাকাম বা ছাদ পেটানোর গান…

প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে দুর নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্‌নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক

– তথ্য সংগ্রহে মীর শাহ্‌নেওয়াজ…

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গুটিকয়েক জমিদার আর ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা নিজেদের থাকার জন্য পাকা ইমারত তৈরি করতেন। ইমারত নির্মাণে তখনো সিমেন্ট, ইট ও স্টোন চিপসের প্রচলন শুরু হয়নি। ইট-সুরকির গুঁড়া ও চুনের মিশ্রণে আস্তরণ তৈরি করে সেটা ছাদের ওপর মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে বসানো হতো। তৈরি হতো জলছাদ। চলতি ভাষায় বলা হত ‘কোবাকাম’। আমাদের শেরপুরে ছেলেবেলায় অনেক দেখেছি, এদের বেহালা বাজিয়ে গানের তালে তালে ছাদ পেটানো দেখার জন্য দলবেঁধে অনেক গিয়েছি। রঘুনাথ বাজারস্থ নিউ মার্কেটের ছাদ পেটানোর স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। ছন্দ-তাল-লয়ের অপূর্ব সুরে এবং অশ্লীলতা ঘেঁষা গানের সাথে ছাদ পেটানো দেখেছি ছোটবেলায়। বাবার কাছে জানতে চাইলে বলেছিল, ‘ওরা ইট-সুরকিরে পিডাইয়া গুড়া গুড়া কইরা ফালায়। আর এ কামডা যাতে সমান ভাবে হয়, হের জন্য এই তালের ব্যবস্থা আর সাথে গান’। এইগুলি আজকে শুধুই স্মৃতি, জীবনে আর কারো দেখার হয়ত সৌভাগ্য হবেনা। ছাদ পেটাতে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। তাই ছাদ পেটানোর এক শ্রেণীর পেশাজীবী শ্রমিক তখন গড়ে উঠেছিল। তবে তৃতীয় লিঙ্গেরও তখন এটা পেশা ছিল, ছাদ পেটানোর সময় নেচে গেয়ে ছাদ পেটাত, আজ ছাদ পেটানো নাই তাই তারা রাস্তায় নেমে এসেছে।

নির্মীয়মাণ ইমারতে ছাদ পেটানোর ছন্দে অনুরণিত ধুপ ধুপ শব্দ ছিল আমাদের খুবই পরিচিত। একজন ওস্তাদের তত্ত্বাবধানে দল বেঁধে এই শ্রমিকরা ছাদ পেটানোর কাজ করত। তাদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করত নারী শ্রমিকরাও। কাজ করার সময় শারীরিক পরিশ্রমের ভার লাঘব করতে, অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করতে তারা এ ধরণের গান গাওয়াকে মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে ব্যবহার করত। ছাদ পেটানোর জন্য শ্রমিকদের হাতে থাকত কাঠের পিটুনি(মুগুর)।
এ গানের মাঝে শ্রমিকরা কাজের উদ্যম ও শক্তি ফিরে পেত। গানগুলোতে সাজানো-গোছানো পরিপাটি কোনো আয়োজন থাকত না। গানগুলো সাজানো গোছানো পরিপাটি মানুষের গান নয়। এই গান ছিল শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র ‘চৌরঙ্গী’ র জন্য কবি নজরুল ইসলাম বেশ কিছু গান রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল-

‘সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো
সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ।
পাত ভরে ভাত পাই না, ধরে আসে হাত গো।
সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ…।’

যা পরবর্তী সময়ে ‘ছাদ পেটানো গান’ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

আগেকার দিনে দরিদ্র শ্রেণীর নারীশ্রমিক ছিল। বিত্তবান ঘরের নারীরা ঘরের বাইরে কাজ না করলেও গরীব নারীরা পেটের দায়ে পুরুষের মতো ঘরের বাইরে কাজ করতো। কিন্তু বিনিময়ে পেটপুরে খাবার পেতো না। তাদের মজুরী ছিল কম। ঘরে সন্তানেরা থাকতো পথ চেয়ে। যৌথ পরিবারের কারণে ছিল শাশুড়ী-ননদীদের গঞ্জনা। কবি নজরুলের এই গানে ছাদপেটা নারীশ্রমিকদের গঞ্জনার এমন করুণ ছবি তাদের মুখেই ফুটে উঠেছে।

এসব গানে ছিল ছন্দ-তাল-লয়ের অপূর্ব মেলবন্ধন। গায়ক ওস্তাদ গানের প্রথম কলিটি গাইত, এর পর শ্রমিকের দল কাঠের তৈরি মুগুর দিয়ে ছাদ পেটাতে থাকত। আর যখনই ওস্তাদের কণ্ঠ থেমে যেত, তখনই শ্রমিকরা ছাদ পেটানো থামিয়ে সমস্বরে গানের কলিটি একই সুরে প্রতিধ্বনিত করত। এভাবেই সম্পূর্ণ গানটি গাওয়া হতো। এ গান অবস্থাভেদে কখনো দ্রুত আবার কখনো ধীর লয়ে গাওয়া হতো। ছাদ পেটানোর তালে তালে সমান্তরালভাবে ধেয়ে যেত গানের তাল। বিষয়বৈচিত্র্য ছিল ছাদ পেটানো গানে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, হাসি-ঠাট্টা, তামাশা স্থান পেত গানের কথায়। আঁস্তাকুড় থেকে কুড়িয়ে আনা বেহালাখানি হাতের জাদুতে এমন অবিশ্বাস্য ধ্বনি সৃষ্টি করতে পারে, তা স্বচক্ষে না দেখলে কিংবা স্বকর্ণে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। সংগীত, বেহালা ও ছাদ পেটানোর ত্রয়ীস্পর্শে অপূর্ব শব্দ ও সুর লহরীর সৃষ্টি হতো। বেহালাবাদক ওস্তাদের কণ্ঠে শোনা যেত-

‘জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে,
মহব্বতের রশির টানে উধাও হইয়াছে।
কেলাস নাইনের ছাত্রী আছিল, গতর-শোভা ভালাই আছিল,
কেম্বে কমু হগল কথা সরম অইতাছে,
জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে…।’

অথবা.

‘ও বুড়ি ও বুড়ি, বুইড়া তোরে কেমন ভালোবাসে?
ফোকলা দাঁতে হাদা খাইয়া কুহুর কুহুর কাশে?’

সঙ্গে সঙ্গে ছাদ পেটানোর দলেও খুশির হিল্লোল বয়ে যেত। সম্মিলিত কাঠের মুগুরের আওয়াজ ঠাস ঠাস শব্দে ছন্দের এক মহোৎসব তৈরি করত। ইমারত নির্মাণের সময়কাল ছিল বর্ষাশেষে হেমন্তকাল থেকে শুরু করে জ্যৈষ্ঠ মাস অবধি। তাই শীতকাল ছাড়া বাকি মাসগুলোতে প্রচণ্ড উত্তাপে এই ছাদ পেটানোর পরিশ্রম ছিল খুবই ক্লান্তিকর। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে ছাদ পেটানোর দল কাজ করত। ওস্তাদের সঙ্গে তখন সবাই মিলে সমস্বরে গেয়ে উঠত –

‘যে-জন আমারে ভালোবাইসাছে—
কলকাত্তায় নিয়া আমায় হাইকোর্ট দেখাইছে;
যে-জন আমারে ভালোবাইসাছে—
গোয়ালন্দ নিয়া আমায় ইলশা খাওয়াইছে…।’

ছাদ পেটানোর গানের কোনও খাতা নেই, নেই স্বরলিপিও। নির্মাণশিল্পে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতা যুক্ত হয়ে ফুরিয়েছে ছাদ পেটানোর প্রয়োজনীয়তা; সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছাদ পেটানো গানও! গানের সেই কথা ও সুরও হয়তো হারিয়ে গেছে।

নজরুল-সঙ্গীত
“সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো”

১) সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো
শুভ্রকান্তি চট্টোপাধ্যায়
https://www.youtube.com/watch?v=AZ4J4EUCasw

২) সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো / চলচ্চিত্র ‘চৌরঙ্গী’
মীরা সরকার, আভা সরকার, মৃদুলা দেবী ও রেণুকা দাশগুপ্ত
https://www.youtube.com/watch?v=sWvH_ATTxOg

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles