আর বেশী কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে – আইয়ুব বাচ্চু…

– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।

“অভিলাষী আমি অভিমানী তুমি
হাজারো স্বপ্ন নিয়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে
পৃথিবীতে বসে আছি সংসার সাজিয়ে
জানে অন্তরযামী কেবা আগে কেবা পরে
সবাইকে একা করে চলে যাব অন্ধ ঘরে
এই শহর গাড়ী বাড়ি কিছুই যাবেনা
আর কত এভাবে আমাকে কাঁদাবে
আর বেশী কাঁদালে উড়াল দিব আকাশে
এই বুকে যন্ত্রণা বেশী সইতে পারিনা
আর বেশী কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে।

অহংকারী মানুস উড়ায় রঙিন ফানুস
টাকা ছাড়া তার দৃষ্টিতে নেই কিছু আর পৃথিবীতে
জায়গা-জমি কিনতে শুধু থাকে সে বেহুস
জমিদার শুধুই জানে সব ব্যাটা তারে মানে
পৃথিবীটা তার দখলে সবকিছু তার কবলে
এক নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নাই জমিদার কি জানে
আর কত এভাবে আমাকে কাঁদাবে
আর বেশী কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে
এই বুকে যন্ত্রণা বেশী সইতে পারিনা
যখন যাবে চলে কাকে যাবে বলে
কেউ যাবেনা সঙ্গী হয়ে
পার পাবেনা পালিয়ে গিয়ে
সবকিছু শুধু ঘটে যাবে চোখের পলকে
হেরে যাব আমি হেরে জাবে তুমি
তাই বলে কেউ না জেনে ব্যাথা দিওনা কারো মনে
কারও মনে দুঃখ দিয়ে সুখ তো পাবেনা
আর কত এভাবে আমাকে কাঁদাবে
আর বেশী কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে।” – আইয়ুব বাচ্চু।

রংপুরের কনসার্টে কিংবদন্তি গায়ক, সঙ্গীতজ্ঞ, গীতিকার ও গীটারবাদক শ্রদ্ধেয় আইয়ুব বাচ্চু তাঁর জীবনের শেষ গান করেন তারই লেখা গান ‘আর বেশী কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে’ এবং সেই সাথে আরেকটি গান করেন ‘এক আকাশের তাঁরা তুই’। জনপ্রিয় এই কিংবদন্তি উড়াল দিয়ে চলে গেলেন এক আকাশের তাঁরা গুনতে, তাঁর অসংখ্য ভক্ত শ্রোতাদের কাঁদিয়ে। যাওয়ার আগে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন তাঁর বাস্তবতার আলোকে কিছু কথা! তাঁর লেখা জীবনধর্মী গান ‘আর বেশী কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে’ গানের মাধ্যমে।

আজকে কিংবদন্তি গায়ক আইয়ুব বাচ্চুর শুভ জন্মদিন। এই জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলতে চাই, তিনি নিজেও হয়তো জানতে পারেননি যে, তিনি এই গানের কথাগুলোর মত সবকিছু ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু তিনি নিজেও হয়তো বুঝতে পারেননি তাঁর সৃষ্টি করা গান, সুর আর তাঁর বাজানো গীটারের ঝংকার এবং তাঁর নিজস্ব ধারায় তিনি যে গান গেয়েছেন তা আজো তাঁর অগুনিত ভক্ত শ্রোতা হৃদয়ের মণিকোঠায় ধারণ করে আছেন। আকাশে উড়াল দিয়েও সে রয়ে গেছেন মাটির কাছাকাছি ভক্তদের মাঝে। কিংবদন্তি গায়ক আইয়ুব বাচ্চু সঙ্গীত জীবনে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর কাটিয়েছেন, সুখে-আনন্দে-গৌরবে তেমনি তাঁর জীবনে ছিল বেদনা, মান-অভিমান আর রোগ-শোকে ভোগার সংগ্রাম। আমরা এই কিংবদন্তি গায়কের জীবনের পেছনের দিকে একটু ফিরে যাই।

শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তি গায়ক আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইশহাক চৌধুরী আর মা নুরজাহান বেগম। তাদের পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে ছিলেন সবার বড়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের জুবিলী রোড এলাকায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন, সেখানেই আইয়ুব বাচ্চুর বেশিরভাগ কৈশোর জীবন অতিবাহিত হয়। ১৯৭৩ সালে তার বাবা তাকে তার ১১তম জন্মদিনে একটি গীটার উপহার দেন। তখন থেকেই সে গান আর গীটার নিয়ে মেতে থাকতেন অথচ এই বয়সের ছেলেরা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় মেতে থাকেন। তার কৈশোর জীবনের শুরুর দিকে সে বিভিন্ন ব্রিটিশ ও আমেরিকান রক ব্যান্ডের গান শোনা শুরু করেন। সেই সময় তাকে গীটার শেখাতো জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ মানুষ। আইয়ুব বাচ্চু চট্টগ্রামে ১৯৭৬ সালে কলেজ জীবনে ‘আগলি বয়েজ’ নামে একটি ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে তার সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ‘ফিলিংস’ (বর্তমানে নগর বাউল নামে পরিচিত)এ যোগদান করেন এবং ব্যান্ডটির সাথে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। একই বছর তিনি জনপ্রিয় রক ব্যান্ড সোলস-এর প্রধান গীটারিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। ব্যান্ড সোলস-এর সাথে তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, সুপার সোলস(১৯৮২), কলেজের করিডোরে(১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এবং ইষ্ট এন্ড অয়েস্ট (১৯৮৮) চারটি এ্যালবামে কাজ করেছিলেন। ১৯৯০ সালের ৫ এপ্রিল তিনি তার নিজের ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ গঠন করেন যা, পরবর্তীকালে’লাভ রান্স ব্লাইন্ড’ নামে বা সংক্ষেপে এলআরবি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে, এলআরবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রথম কনসার্টটি করে। কনসার্টটি বাম্বা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে তারা বাংলাদেশে প্রথম ডাবল এ্যালবাম; এলআরবি ১ এবং এলআরবি ২ প্রকাশ করেছিল। ব্যান্ডটির তৃতীয় স্টুডিও এ্যালবাম ‘সুখ’ জুনে মুক্তি পায় এবং এটি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রক এ্যালবামগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে ‘চল বদলে যাই’ গানটি ছিল যা আইয়ুব বাচ্চুর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বিবেচিত। তারা ১৯৯০ এর দশকে আরও কয়েকটি এ্যালবাম প্রকাশ করে এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রক ব্যান্ডের মধ্যে একটি হয়ে উঠে।। ১৯৯৬ সালে তারা ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠান করেছিল, যা বাংলাদেশের বাইরে তাঁদের প্রথম কনসার্ট ছিল। এলআরবি নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠান করা একমাত্র বাংলাদেশী ব্যান্ড। ২০০৯ সালে তারা নোকিয়া মিউজিক ফেস্টিভ্যালে গান করে এবং ২০১১ সালের ২রা জানুয়ারি এলআরবি নগরবাউল ও মাইলস ব্যান্ডের সাথে গান করে।

একক এ্যালবাম-
রক্ত গোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৮), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মত (২০০৩), পথেরগান (২০০৪), মাটিরটানে মাটিরগানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), রিমঝিমবৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প(২০১৫)।

ব্যান্ড এ্যালবাম-
এলআরবি (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও(১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারি মন (১৯৯৬), স্বপ্ন(১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাব (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮), যুদ্ধ(২০১২)।

নেপথ্যে কণ্ঠশিল্পী-
লাল বাদশা (১৯৯৯), আম্মাজান (১৯৯৯), গুন্ডা নাম্বার ওয়ান (২০০০), ব্যাচেলর (২০০৪), রং নাম্বার (২০০৪), চাঁদের মত বউ (২০০৯), চোরাবালি (২০১২), এল কাপ চা (২০১৪)।

কিংবদন্তি গায়ক আইয়ুব বাচ্চু এলআরবি’র সাথে ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। সে ২০০৪ সালে বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন সেরা পুরুষ ভোকাল বিভাগে। কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু ২০১৭ সালে টেলি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার জিতেছিলেন।
কিংবদন্তি গায়ক আইয়ুব বাচ্চু জীবনের শেষ গান ‘আর বেশী কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে’ গানটি গেয়ে এবং গানের কথাগুলোকে সত্যি রূপান্তর করে ঠিক একদিন পর ১৮ অক্টোবর ২০১৮ সালে যেন আকাশে উড়াল দিয়ে চলে গেলেন তাঁর শত শত ভক্ত শ্রোতাদের কাঁদিয়ে। যার গানে ছিল কষ্ট, অভিমান, এবং ভালোবাসার সুখ দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। আর হয়তো এত অভিমানী কন্ঠ আমরা ফিরে পাবো না! হয়তো পাবো না এমন একজন বন্ধুবৎসল মানুষ এবং নবীন প্রবীণ সবাইকে আপন করে নেয়ার অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষের দেখা। যার আবেগ, অভিমান এবং কষ্ট বেজে উঠতো তাঁর প্রিয় বাদ্যযন্ত্র গীটারের সুর মূর্ছনাতে।

আজকে এই অসাধারণ এবং কিংবদন্তি গায়ক আইয়ুব বাচ্চুর জন্মদিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং সেই সাথে আল্লাহ্‌ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন এই দোয়া করছি, সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে। কিংবদন্তি এই শিল্পী যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।

ছবি – বায়েজিদ ওয়াহিদ