শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু মৃত্যুকে সংবর্ধিত করে নিজেকে মৃত্যুহীন করেছেন। দেহকে মাটিতে শায়িত করে আত্মাকে গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর তুলে নিয়েছেন। তিনি জীবনের বিলোপ ঘটিয়ে মহাশূন্যের দূর নক্ষত্রে পাড়ি দিয়েছেন-নশ্বর থেকে অবিনশ্বরের বাসিন্দা হয়েছেন। তার সমগ্র জীবনের মনোযাতনার অবসান আর হৃদয়ের অনুশোচনা দূর করে ঘৃণার গরল নিঃশেষে অপসারিত করে সুরের পালকিতে উড়াল দিয়ে মহা জীবনের পথে পাড়ি দিয়েছেন। হয়তো সেখানে তিনি নক্ষত্র শোভিত গিটারের জোছনা মাখানো তারে স্বর্গীয় সংগীতের উপাসনা করছেন। জীবনের আশা, সম্মান, সম্পদ, জনপ্রিয়তা জাগতিক সব বিষয়কে চিরদিনের মতো বিদায় করে-নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে অপার্থিব এক উৎস থেকে শক্তি সঞ্চয় করে দূর আকাশের যাত্রী হয়েছেন। কাল থেকে কালাতীত এবং লোক থেকে লোকাতীত হওয়ার বাসনা আইয়ুব বাচ্চুর প্রবল হয়েছিল ফলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় অতি গোপনে অতি তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়েছেন, পরমানন্দকে অনুসন্ধান করতে।
তার যাপিত জীবন এবং মৃত্যু সব জেনেশুনে মনে হয়েছে সংগীতেই আকাক্সক্ষা, যন্ত্রণা, অনুভূতিকে উৎসর্গ করেছেন। তার অন্তরবেদনাকে, অতি কষ্টকে কী গোপনীয়তার সঙ্গে লালন করেছেন-তা আমরা কেউ অনুধাবন করতে পারিনি। তার হাসির আড়ালে দুর্বোধ্য বিষাদের আচ্ছন্ন মুখ আমরা কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারিনি। ব্যক্তিগত আঘাত-আক্রমণ কোনোটাই সমাজে প্রকাশ করেনি। কী অসাধারণ তার ব্যক্তিত্ব। এখানেই আইয়ুব বাচ্চু অনন্য সাধারণ। তিনি দেহগত ক্ষয়-অসুস্থতার মাঝেও কাউকে অভিযুক্ত করেননি। আইয়ুব বাচ্চু স্বকীয় ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল। ব্যান্ড সংগীতকে জনপ্রিয় এবং ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। মঞ্চে গান গাইতে ওঠে শ্রোতাদের আনন্দে অনুপ্রাণিত করার জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সুভাগ্য-দুর্ভাগ্য সবকিছুকে অবহেলা করে অতিক্রম করে ফেলেছেন। সব দুঃখ-বেদনা এবং অমরত্বক মৃত্যুর মধ্যদিয়ে পরিপ্লাবিত করে দিয়েছেন। পরিশেষে আইয়ুব বাচ্চু আত্মপোগন করেছেন-আত্মাকে বাঁচাতে।
আত্মাকে বাঁচাতে পেরে চরম আত্মতৃপ্তির সুবাসিত সুষমায় বিভোর হয়ে থাকবেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। তিনি আমাদের সঙ্গে সম্পর্কে জাল ছিন্ন করে দিতে পেরেছেন অনায়াসে। কিন্তু যে অদৃশ্য জগতে অদৃশ্য সম্পর্কের জালে আইয়ুব বাচ্চু নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন-সে জাল ছিন্ন করার কোনো শক্তি পৃথিবীর নেই।
গান হচ্ছে আত্মার বসন্ত সৌন্দর্যের নির্মাতা। এই সৌন্দর্য নির্মাণেই আইয়ুব বাচ্চু তার আত্মাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চু তার গানে চিন্তার মৌলিক আদর্শ, নীলিমার স্তব্ধতা, স্বপ্নের আবেশ, স্বতঃস্ফূর্ত চেতনা এবং এমন এক ভাবজগতের সন্ধান দিতে চেয়েছেন যা জীবনমুখী-বাস্তববাদী। আইয়ুব বাচ্চু তার গান দিয়ে ব্যাকুলতা-বিষণ্ন তার নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন, মুষড়ে পড়া স্বপ্নগুলোকে উদ্ধার করতে চেয়েছেন, দুঃখ কষ্ট যেখানে সমাপ্তিতে আবর্তিত হতে চেয়েছে আইয়ুব বাচ্চু সেখানে গানের মাধ্যমে অক্ষয় মোহনীয়তা এনেছেন। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছেন, মাটিকে ভালোবেসেছেন-সূর্যকে ভালোবেসেছেন। আর যা তার বিবেক এবং চিত্তকে অসম্মান করে তা তিনি পরিত্যাগ করেছেন।
তিনি তার দীর্ঘ সংগীত জীবনের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সংগীতের দেহে। তিনি সংগীতের সব আবেগকে সংহত করতে চেয়েছেন সুরের লহরীতে। তার সংগীতে চিন্তার অজ খোরাক আছে। তিনি কথা আর সুরের সৌন্দর্যে নির্মাণ করেছেন গানের শরীর। তিনি প্রায় ৪০ বছরের অধিক নিরবচ্ছিন্ন সংগীত সাধনা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। সুরের বন্ধনা, জীবনের অভিজ্ঞতা, সত্য ও জ্ঞানকে নির্বিচারে গ্রহণ করার মতো হৃদয় ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। ফলে তিনি ক্রমাগত হয়ে উঠেছেন সংগীতের কবি। তার গায়কি, তার উচ্চারণ ঢং, তার বৈশিষ্ট্য এবং রুপালি গিটারের তারের মূর্ছনায় নিজেকে এক ভিন্নতর উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি সুরের সৌন্দর্যে পরিপ্লাবিত হয়ে ফিরে পেতেন সৃষ্টিশীলতাকে, বিভোর হয়ে থাকতেন, অনুপ্রাণিত হতেন। তিনি ক্রমে ক্রমে মিশেছেন জনতার কল্লোলে, জনতার উল্লাসে। আইয়ুব বাচ্চুর গান হৃদয় থেকে হৃদয়ে প্রকাশ্যে বা সংগোপনে সৌরভ ছড়াবে দীর্ঘদিন।
আমি নিজের ইন্দ্রিয়কে নিংড়ে আর চেতনাকে ভেঙেচুরে আত্মার গভীর তলদেশ থেকে যে গান লিখেছিলাম ‘ও আমার সাদা কাফনে দাগ লাগাইয়া দিয়ো-অন্তরে দাগ বাইরে সাদা ভালো দেখায় না-শেষ বিদায়ে ভিতর বাহির সমান করে দিয়ো’ আমার লেখা সেই গান গেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এ গান আমার আত্মা থেকে উৎসারিত। আইয়ুব বাচ্চুর সাদা কাফন আমরা দেখতে পেরেছি কিন্তু ভিতরের যন্ত্রণা দগ্ধ হৃদয় আমরা দেখতে পারিনি। কি বিস্ময়কর গোপনীয়তায় আইয়ুব বাচ্চু তার বেদনা-যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা-নির্জনতাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। দীর্ঘশ্বাস আর বেদনার্ত হাহাকার কবেই তাকে সমাহিত করে দিয়েছিল-যা আমরা চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে পারিনি। তার আত্মার পবিত্র প্রকোষ্ঠে কী বেদনার নদী নির্মাণ করেছিলেন তা শুধু আইয়ুব বাচ্চুই জানেন। আমার সাদা কাফনে দাগ লাগাইয়া দিয়ো এটা আমার সত্তার গোপনীয়তা। সাদা কাফনে দাগ দিয়ে আমি আমার আত্মাকে ভারমুক্ত করতে চেয়েছি। কারণ উম্ম ত্ত ভূম-লে আমাদের জীবনজুড়েই চৈতন্যের নৈরাজ্য। কারণ আমরা বাইরে যা প্রকাশ করি ভিতরে তা লালন করি না। আমাদের ভিতর থাকে ফাঁকা আর নিজেদের দেই ফাঁকি-প্রতারণা করি নিজের সঙ্গে নিজেই। ভিতরজুড়ে প্রবল অন্ধকার রেখে বাইরে আলোকিত মানুষের আস্ফালন করি। মৃত্যুর পরেও যেন বৈপরীত্য ও ভ-ামি-মিথ্যা না থাকে। জীবনে আশা-আনন্দে যেমন অফুরান নই, সত্যের বেদিতে উৎসর্গকৃত নই, বেদনার চাদরেও বহুবার আত্মগোপন করছি, সুতরাং সাদা কাফনে আমাকে মানায় না, জীবন এবং মৃত্যুতে কোনো খানেই না। আমি জীবন এবং পরপার দুই জায়গাতেই সমান দোষী থাকতে চাই। প্রত্যেকের জীবনটাই বড় ধরনের শাস্ত্র। আমি আমার জীবন শাস্ত্রের টীকা নির্মাণ করেছি-আমার সাদা কাফনে দাগ লাগাইয়া দিয়ো আমি মনে করি এটাই হবে আমার জন্য প্রশান্তিজনক এবং যুক্তিসঙ্গত। আমার এ আত্মোপলব্ধি আত্মনির্মাণের স্মরণিতে আইয়ুব বাচ্চু জড়িত। আমার লেখা যেসব গান আইয়ুব বাচ্চু গেয়ে আমার চেতনা ও অনুভূতিকে ঋণী করে ফেলেছেন তার অন্যতম।
১. ‘কেন এত শত্র“ হলে-এই ছিল কি কপালে-যার কারণে পৃথিবীর তিনভাগ ভরলাম চোখের জলে’ ২. ‘সূর্যের মুখোমুখি কতবার হয়েছি… করজোরে প্রার্থনায় নত হয়েছি-তবু হৃদয়ের দাগ মুছে ফেলতে পারিনি’ ৩. আমি বড় রঙ্গের মানুষ-আকাশের সব তারা পুড়ে ছাই করে দিয়েছি ৪. ভালোবাসা জমা করে দুর্ভিক্ষ করিস না ৫. এক বেলার ভালোবাসা-কেন বাসলে আমারে এসব গানে আমাকে বেশ প্রভাবিত করেছে। এসব গানের সুরকার আজমির বাবু ও আইয়ুব বাচ্চু নিজেই। সাউন্ডটেক থেকে প্রকাশিত আসিফ আকবর ও আইয়ুব বাচ্চুর ডুয়েট অ্যালবাম ‘বায়না’ অডিও জগতে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আমরা সবসময় বিবেককে বিকিয়ে দিয়ে চিরকাল যে লোভের চির দাসত্বের শেকলে বাঁধা পড়ে আছি তা এসব গানে প্রতিফলিত হয়েছে, অধঃপতনের লজ্জা আর অন্তরের শুচিতা এ দুটো থেকে একটিকে বেছে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে। জীবনের দুটো নীতি একটি নীতি ভালো আর আরেকটি নীতি খারাপ, একদিকে পরিমাপকৃত পুণ্য-অন্যদিকে ওজনকৃত পাপ। একটা আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হলে আরেকটা স্বার্থপর হতে শেখায়। একটা নীতি বেরিয়ে আসে আলোর সুউচ্চ স্তম্ভ থেকে আরেকটা আসে অন্ধকার অতল গহ্বর থেকে। এটাতেই জীবনের বড় সংকট। চরম দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়ে যা কিছু ভালো তাকেই জয়লাভ করতে হয়। সৃষ্টি ও ধ্বংস জীবন ও মৃত্যুর দ্বৈতলীলা একদিকে উজ্জ্বল আলোর বিকিরণ অন্যদিকে কৃষ্ণকুটিল অন্ধকার। একদিকে অনন্ত আকাশের অজানা নক্ষত্রের আলো-আরেকদিকে রহস্যময় অন্ধকার এসব বিষয় দিয়ে আমার ও আইয়ুব বাচ্চুর গানে বার্তা দিতে চেয়েছি, বিবেক এবং আত্মাকে সতর্ক করতে চেয়েছি-মহৎ সত্যকে অনুসন্ধান করতে চেয়েছি। শার্ল বোদলেয়ার বলেছিলেন সংগীত খনন করে স্বর্গকে। অতএব তিক্ত জীবনের আনন্দকে জান আর প্রার্থনা কর অবিরত প্রার্থনা কর। আমরাও সংগীত খননকারী আইয়ুব বাচ্চুর জন্য অবিরাম প্রার্থনা করব।
লেখক : গীতিকবি।