Saturday, September 13, 2025

দ্যা বস্ (ছোটগল্প)…

– গুঞ্জন রহমান…

এই গল্পের (প্রায়) প্রতিটি চরিত্র বাস্তব, স্থান এবং কালও বাস্তব। তবে কাহিনীটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। আরো সহজ করে বলি, এই গল্পে যে চরিত্রগুলির কথা বলা হয়েছে, তাদের বাস্তব উপস্থিতি আমাদের জানাশোনা জগতে আছে কিংবা ছিল। তবে যে ঘটনাটি এই গল্পের উপজীব্য, সেটির উদ্ভব কেবলই গল্পকারের মগজে, বাস্তবে এমনটি কখনো ঘটেনি। তবে লিখে শেষ করার পর গল্পটি যখন আদ্যপান্ত পড়ে শেষ করলাম, তখন আমারই উপলব্ধি হলো, এমন একটি ‘খুবই সম্ভব’ ঘটনা কেন যে ঘটেনি কোনোদিন!

এক.
মোল্লা ছাত্রাবাসটা খুঁজে বের করতে মূল্যবান অনেকটা সময় চলে গেল। মোল্লা ছাত্রাবাসে জাহিদ থাকে। এই মাসেই উঠেছে। এর চেয়ে সস্তার মেস নাকি রাজশাহীতে আর নাই। অতএব জাহিদ ছাড়া আর কারো এই মেস চেনার কথাও না। এই সময়ে অবশ্য তাকে ঘরে পাওয়া যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জাহিদের থিয়েটার গ্রুপের ছুটিই হয় সন্ধ্যে মিলিয়ে। তারপর হলপাড়ায় মেয়েকর্মীদের পৌঁছে দিয়ে, পানির ট্যাংকির নিচে সারাটা সন্ধ্যে আড্ডা দিয়ে গলির মুখের নেড়ি কুত্তাগুলো মোটামুটি ঘুমিয়ে যাবার পর তার ঘরে ফেরার সময় হয়। তবে আজ যেহেতু কোথাও তাকে পাওয়া গেল না, সফিকের ইনট্যুশন বলছে ঘরেই পাওয়া যাবে তাকে।

এবং হলোও তাই। জাহিদ ঘরেই ছিল। অসময়ে তাকে ঘরে দেখে সফিকের প্রথম প্রশ্ন করা উচিত ‘কী রে তুই আজ ক্যাম্পাসে না গিয়ে ঘরে শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ নাকি?’ কিন্তু সফিক সেসব সামাজিক সম্পর্কের ধারে-কাছে গেলো না। হাতে সময় কম। সে খুব ব্যস্ত হয়ে তাড়া লাগালো, ‘ওই উঠ, শার্ট পর, প্যান্ট পর। তাড়াতাড়ি বার হ’।
জাহিদ বিকট একটা হাই তুলে আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলামের মতো ভারী গলায় বললো ‘শরীরটা ভালো না রে’ ‘শরীরের ভালো খারাপ পরে দেখা যাবে। তুই জলদি কর… টাইম নাই’
‘কেন? কী হইছে! কেউ মরছে নাকি?’
‘এখনো মরে নাই, তবে দেরি করলে মরতেও পারে’
‘কেন রে? কার কী হইছে? কে মরতে পারে!’

জাহিদ দ্রুত বিছানা থেকে নামতে যায়, খেয়াল করে না যে ঘুমের ঘোরে লুঙ্গির গিঁট আলগা হয়ে গেছে। অবশ্য সফিক সেসব খেয়াল করে না, সে স্বভাবমতো কোনাকাঞ্চিতে হাতাতে শুরু করেছে, দু-একটা সিগারেট যদি পাওয়া যায়! মাসের শেষ, হাত খালি। মাসের এ সময়টা কেউই নিজের স্টক যেঁচে পড়ে ডিসক্লোজ করতে চায় না। জাহিদ লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বললো, ‘মোটা বইটার ফাঁকে দেখ, একটা থাকার কথা’।
একটু থেমে আবার জানতে চাইলো, ‘কে মরতে পারে, কইলি না?’
‘তুই! আবার কে? … শালা বস্ আইছে রাজশাহীতে তিন ঘন্টা হয়া গেল, এখন পর্যন্ত খোঁজ পাই নাই কই আছে। খুইজা বাইর করতে না পারলে তোরেই মাইরা ফালামু শালা গরু… খুব বড়লোক হইছিস না? শালা বিয়াইত্তা ভদ্দলোকদের মতো দুপুর বেলা লুঙ্গির খোঁট খুইল্লা ঘুম গেছিস। এইদিকে বস্ আইসা ঘুইরা যায় আরকি!’

এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে সফিক আবার ড্রয়ার হাতাতে শুরু করলো, সম্ভবত ম্যাচের খোঁজে। এদিকে জাহিদ কী বলতে যেন মুখ খুলেছিল, বন্ধ করতে ভুলে গেল! বিকট হাঁ করা মুখের ভেতর দিয়ে তার আলাজিব দেখা যেতে লাগলো। সেটা দেখে সফিক আবার ধমক লাগালো – ‘মুখ বন্ধ কর ব্যাটা! লোল পড়তেছে। যা দাঁত ব্রাশ কর! এই মুখ নিয়া বসের সামনে গেলে…’

বাকিটা শোনার জন্য জাহিদ আর দাঁড়ালো না, হনহন করে ছুটলো কলতলার দিকে। এবং পরক্ষণেই আবার ফিরে আসলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ব্রাশ-পেস্ট, সাবান-তোয়ালে কিছুই নিতে মনে ছিল না। কোনো মানে হয়? বস্ এসেছেন রাজশাহীতে… তাও তিন ঘন্টা হয়ে গেল, সে তার কিছুই জানে না? বসের যে প্রোগ্রাম আছে – কেউ সেটা জানে না? কেউ একবারও বললো না! এতটাই দুর্দিন এসেছে তার যে, বসের প্রোগ্রামের কথা পর্যন্ত কেউ তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছে না? নাহয় সে থিয়েটার করতে শুরু করেছে, এবং বেশ সিরিয়াসলিই সেটা করছে, কিন্তু তার সাথে তো বসের প্রোগ্রামের… নাহ্ জাহিদ আর কিছুই ভাবতে পারে না। ভাগ্যিস সফিক তাকে ডাকতে এসেছিল। সে তো একাই চলে যেতে পারতো। রাজশাহী খুব ছোট শহর। বসের মত মানুষ কোথায় উঠতে পারেন, অনুমান করা কঠিন কিছু না। সে যদি নিজেই খুঁজে নিয়ে বসের সাথে দেখা করতো, তার কাছে ব্যাপারটা স্রেফ চেপে যেত, কার কী বলার ছিল? কিন্তু সে তা করেনি। বন্ধু একেই বলে। সফিক জানে, বসের সাথে দেখা করা জাহিদের জন্য কতটা জরুরী। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার হতে পারে এটা। জাহিদ আর ভাবতে পারে না। ধুর! বছরে একটা দিন আলসেমী করে দুপুরে ঘুমাতে গেল, আর আজই কিনা সেই দিন…

দুই.

পর্যটন মোটেল লোকে লোকারণ্য। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তবে ফ্লাডলাইটের আলোয় মোটেলের চারপাশ ঝলমল করছে। এই জায়গাটা কি সারা বছরই এমন থাকে, নাকি আজ বসের আগমনে এই অবস্থা? দূর থেকে জাহিদের মনে হল, যথেষ্ট দেরি তারা করে ফেলেছে। মনে হয় না বসের কাছাকাছি ভীঁড়তে পারবে আজ। তার মধ্যে তারা মাত্র তিন জন। তাও ভালো, আসার সময় কাজলা মোড়ে হাসানের সাথে দেখা। বস্ এসেছেন শুনে সে-ও সাথ ধরলো। সফিক মৃদু আপত্তি করেছিল, কিন্তু জাহিদই টেনে নিলো হাসানকে। দলভারী হতে হয়। শো-ডাউনের ব্যাপার আছে। তাছাড়া বসের সাথে যে তাদের দেখা হয়েছে – তার যথেষ্ট স্বাক্ষীও তো থাকা দরকার। ইস একটা ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলে রাখা যেত। সবার হাতে হাতে মোবাইল এবং সেই মোবাইলে মেগাপিক্সেল ক্যামেরা আসতে তখনো বছর দশেক বাকি! কী আর করা…

কিন্তু পর্যটন মোটেলে বস্‌কে পাওয়া গেল না। কেউ ঠিকঠাক বলতেও পারে না, তিনি আদৌ এখানে উঠেছেন কিনা। রাজশাহীতে এর চেয়ে ভালো থাকার জায়গা আর কই? ডায়মন্ড হোটেলেও এসি রুম আছে, কিন্তু বসের যে ক্যালিবার, তার সাথে ডায়মন্ড হোটেল যায় না। একদমই না। সফিকের তবু একবার ঢুঁ মেরে দেখার ইচ্ছা। বলা তো যায় না, হয়তো দেখা গেল, যার প্রোগ্রামে এসেছেন বস্, সে বেচারার সাধ্য তেমন নেই। এদিকে বস্ তো আর কারো উপর জোর-জবরদস্তি করবেন না। তিনি নিশ্চয়ই বলবেন না, ‘আমাকে এই এই দিতে হবে, এইভাবে নিয়ে যেতে হবে, এই জায়গায় রাখতে হবে, এই এই খেতে দিতে হবে – তবেই আমি যাবো, নয়তো রাস্তা মাপো!’ সুতরাং ডায়মন্ড হোটেলও দেখে যাওয়া যাক। তাছাড়া হোটেলটা তাদের ফেরার পথেই পড়বে।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছিল না। জাহিদের বদ্ধমূল ধারণা, বস্ পর্যটনেই উঠেছেন। হয়তো এসেই লাগেজপত্র রেখে আবার বেরিয়েছেন, কোথাও কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে আবার ঠিকই ফিরে আসবেন। এখানেই অপেক্ষা করতে পারলে যত রাতই হোক দেখা হয়েই যেত। এখন একান্তই যদি দেখা পাওয়া না যায়, তো কাল সরাসরি প্রোগ্রামে গিয়েই দেখা করতে হবে। সেটা করতে হলে জাহিদের অপমানের কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। রাজশাহী শহরের এমনকি প্রতিটা মোড়ের ট্রাফিক পোস্টগুলো পর্যন্ত জানে এবং মানে, জাহিদই এখানে বসের একমাত্র স্থানীয় প্রতিনিধি। আর সেই জাহিদই কিনা বসের আগমন সম্পর্কে পুরোপুরি বেখবর! কোনো মানে হয়?

ডায়মন্ডেও খোঁজ পাওয়া গেল না। যাবে না, তা জানাই ছিল এক রকম। অর্কিড, বিলাস, সেঞ্চুরি – কোথাও নেই। ধুর, এসব জায়গায় খুঁজতে যাওয়াই ভুল হয়েছে। বসের রুচি এত নিচে কোনো মতেই নামতে পারে না। আচ্ছা, বস্ হোটেল-মোটেলে না উঠে কারও বাসায় উঠেন নি তো? তা কী করে হয়! সে যতদূর চেনে, তিনি এমনটা কিছুতেই করবেন না। একেবারে পারিবারিক সম্পর্কের ব্যাপার হলে আলাদা কথা। তবে বসের সে রকম কোনো ঘণিষ্ঠ আত্মীয় রাজশাহীতে নেই – এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

হাঁটতে হাঁটতে তিনজনেরই অবস্থা তখন কাহিল। হাসানকে তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নেহায়েত চক্ষুলজ্জার খাতিরে বলতে পারছে না – ‘ভাই, আপনারা খুঁজতে থাকেন, আমি গেলাম!’ ঘুরে ফিরে তারা আবার সাহেববাজারে এসে থমকে দাঁড়াতেই জাহিদের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সফিক। জাহিদ ঘড়ি দেখলো, সাড়ে দশটা। রাত কম হয়নি। রাজশাহীর মতো শহরের জন্য যথেষ্টই রাত বলা চলে। ফিরতি রিকশাভাড়া বাবদে যে টাকা পকেটে ছিল, সেটা এখন আর যথেষ্ট নয়। রাত সাড়ে দশটায় এই ভাড়ায় কোনো রিকশা যেতে রাজী হবে না। এদিকে খিদেয় পেটে ছুঁচো দৌড়ুচ্ছে। বিশ টাকায় তিনটে লোকের পেট ভরানোর মতো মুড়ি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবার কথা নয়। এতক্ষণে হলের ডাইনিংও ধোয়ামোছা হয়ে গেছে। আজ রাতটা নিজের ব্যবস্থায় চালিয়ে নিতে হবে। এত কষ্টের মধ্যেও সেই ভিখারির কৌতুকটা মনে করে হাসি পেল জাহিদের – যে বলতো, ভিক্ষা জুটলে আমার পেট আল্লায় চালায়, আর না জুটলে আমিই চালাই!

জাহিদকে হাসতে দেখে সফিক খেঁকিয়ে ওঠে, ‘মামুর বুঠা, খুব হাসি আইসছে নাখি? জবের ব্যাপার, তোর পিছে ঘুরতে ঘুরতে হামারঘে শোকায় বাঁশ যাছে, আর তুই হাইসছিস!’ তিন জনের একজনও রাজশাহীর স্থানীয় নয়, তবে আড্ডার মুডে পেলে তারা স্থানীয় ভাষায় অনর্গল এ ওকে ঝাড়তে থাকে। স্থানীয় অর্থাৎ ‘লুখাল’রা অবশ্য ঝাড়া বলে না, বলে লাড়া। কাখে লাইড়তে কাখে ল্যাড়ে লিয়েছো মামু? … জাহিদ হাসি না থামিয়েই বলল, ‘হাইসবো না তো কী কইরবো? বশ (বস্) আস্যাছে হামার টাউনে, আর হামি কিনা ঢুঁড়ে পাছি নাখো! ডুব্যে যে মইরবো তা পোখোর (পুকুর)গুল্যাও তো ভরাট কর‍্যা ফেল দিয়্যাছে মামুর বুঠারা!’ সোহেল এতক্ষণে কথা বললো, ‘ভাই, পোখোর আর কতি লাগে? হামারঘে তিনজনার শরীর দিয়্যা ঘাম যত বারালছে, গঞ্জিগালা চিপ্যা ফেললে অর পানিতেই ডুবতারবেন!’
সফিক হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল, ‘হ্যাঁ রে! কপাল এতই খারাপ আমাদের… এতক্ষণ ধরে হাঁটলাম, বসের কোনো খবরই পাইলাম না রে! এইটা একটা হইলো কিছু? এতক্ষণ ঘুরলে তো ঢাকায় গিয়াই বসের সাথে দেখা করতে পারতাম!’ জাহিদের চেয়ে যেন সফিকের হতাশাই বেশি। অথচ সেই যে বিকেল থেকে সফিক হন্যে হয়ে জাহিদকে খুঁজছে, জাহিদকে সাথে নিয়েও এই প্রায় তিন-চার ঘন্টা ঘোরা হয়ে গেল, এর পেছনে বসের সাথে দেখা করার তার ব্যক্তিগত আগ্রহের চেয়ে বরং জাহিদকে বসের সামনে নিয়ে যেতে পারার আকাঙ্ক্ষাই বেশি।
জাহিদ হঠাৎ বললো, ‘চল, চা খাই’।
হাসান অবাক হয়ে তাকালো, ‘এত রাতে চা? ক্ষিদা লাগছে বস্!’
জাহিদ খিঁচিয়ে উঠলো, ‘বস্ মানে? বস্ ক্যাডা, আমি? ব্যাটা অরজিনাল বস্ এখন এই শহরে বসা। মনে কর আমাদের আশপাশ দিয়াই হয়তো যাইতেছে এখন, আর তুই আমারে বস্ ডাকিস ? তুই তো মরবি মরবিই, আমারেও মাইরা ফালাবি!’
‘না মানে, অরজিনাল বস্‌রে তো আর সামনাসামনি দেখি নাই কোনো দিন, আমাদের কাছে তো আপনিই বস্!’
‘চুপ! ভুইলা যা। অন্তত আমার বস্ যতক্ষণ রাজশাহীতে, ততক্ষণ এই কথা মনেও আনবি না। খবরদার’
‘ওকে বস্… না মানে, ভাই। স্যরি, ভুল হয়া গেছে’
‘চল, চা খাই’।
হাঁটতে হাঁটতে সফিক বললো, ‘বাটার মোড়ে যাবি নাকি? চা খাইতে এত দূর?’
‘পকেটে যে টাকা আছে, বড় জোর বাটার মোড়ের স্পোশাল চা-ই হবে। রাতে আর কিছু জুটবে না। অন্তত ভালো এক কাপ চা খাইলে সারা রাতের সান্তনা’।
‘কী বলিস! টাকা তো আছে!’
‘টাকা আছে মানে? তোর কাছে টাকা আছে? পাইলি কই!’
‘বস্ আইছে শুইনাই পাঁচশো টাকা ধার করছি। টাকা লাগবো না?’
‘কস কী তুই? মাসের এই সময় ধার পাইলি কই থিকা? কে দিল?
‘আরে আমাদের ফাদার তেরেসা আছে না!’
‘বাহার? বাহারের কাছে টাকা ছিল?’
‘ছিল না। সে কই কই থেকে জানি খুঁজে আনছে। আমি বলছি বস্ আসতেছে, টাকা লাগবো। বাহার রোকেয়া না তাপসী রাবেয়া – কুন হল থেকে জানি আনলো দেখলাম!’
‘হাহ্! সাধেই কি আর ওরে ফাদার তেরেসা কয়!’
হাসান বললো, ‘তাইলে বস্, চলেন বাটার মোড়েই যাই, আগে জিলাপি খাইয়া পেট ঠাণ্ডা করি। তাছাড়া জিলাপি তো মিষ্টি, মিষ্টি মানেই এনার্জি। ফুয়েল পাইলে আরো ঘন্টাখানেক দৌড়াইতে পারবো’।
‘বাটার মোড়ের জিলাপি কি এখনও পর্যন্ত খোলা থাকবে?’
‘থাকবে না? মাত্র তো সাড়ে দশটা’
‘সাড়ে দশটা ছিল, এখন পৌনে এগারোটা হয়ে গেছে। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে এগারোটা’
‘চলেন, আগে দেখি তো!’
হাসান হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। তার গতি প্রায় ম্যারাথনের দৌড়বিদদের কাছাকাছি। ভাবখানা এমন যে, সে আগেভাগে গিয়ে দোকানীকে থামিয়ে রাখবে, যেন বন্ধ করে না দেয়। দেখে মজাই লাগলো জাহিদ-সফিকের। আহারে ফার্স্ট ইয়ার!
আচমকা থমকে দাঁড়ালো হাসান। পেছন ঘুরে একই রকম হনহন করে ফিরে এলো। দূরে থাকতেই সফিক জিজ্ঞেস করলো,
‘কি রে, ঘুরে আসতেছিস যে?’
‘খিদায় না বুদ্ধিসুদ্ধি ঘোলা হয়ে গেছে গা। ভাই, এখন তো টাকা আছে, আমরা রিকশা নিতেছি না কেন?’
‘আরে তাই তো!’

অগত্যা তিনজনে একটা রিকশা ডাকে এবং রওনা হয় বাটার মোড়ের বিখ্যাত জিলাপির খোঁজে। ক্ষিদের সাথে পাল্লা দিয়ে তিন জনেরই মনে সংশয়, এত রাতে জিলাপির দোকান খোলা থাকবে তো? এ মুহূর্তে কারুরই মনে রইলো না, ‘বস্’ নামক ব্যক্তিটি, যার খোঁজে তারা পুরো রাজশাহী শহর চষে ফেলেছে, সেই মানুষটির খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।

তিন.

বাটার মোড়ের জিলাপির দোকান খোলা ছিল। শুধু খোলা ছিল যে তাই নয়, রীতিমতো গরম জিলাপী ভাজা হচ্ছিল, যেমনটা সন্ধ্যা রাতে ভাজা হয়। আশ্চর্য ব্যাপার যে, দোকানে কোনো ভীঁড় নেই, অথচ কারিগর বিশাল কড়াই ভর্তি করে জিলাপি ভেজেই যাচ্ছে। দোকান খোলা থাকায় সফিক যতটা খুশি হয়েছিল, এই ব্যাপারটা খেয়াল করে ততটাই দমে গেল। নিশ্চয়ই কারো অর্ডারের জিলাপি ভাজা হচ্ছে। কোথাও হয়ত বিয়ে কিংবা মিলাদ বা এ জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান, তারই অর্ডারের জিলাপি ভেজে তৈরি রাখছে কারিগর। এ ব্যাটাকে এখন অনুরোধ করে লাভ নেই। পাঁচ মণ জিলাপি থেকে পাঁচ ছটাক সে আলাদা করবে না। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সফিকের জানা আছে ব্যাপারটা। দূর! এতখানি আসাটা বেকার গেল। আজ দিনটাই একটা কূফা দিন। সকালে ফয়জার স্যার ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তখনই তার বোঝা উচিত ছিল। কী এমন করেছিল সে? শুধু পাশে বসা শাহীনকে জিজ্ঞেস করেছিল ক’টা বাজে। তাও ফিসফিস করে, অত দূর থেকে স্যারের সেটা কোনো মতেই শুনতে পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু শাহীন যে একটা ছদ্মবেশী পাগল, থেকে থেকেই যে তার মাথায় পোকা নড়ে ওঠে – সেটাই বা ভুলে গেছিল সে কোন আক্কেলে! পাগলা শাহীন রীতিমতো চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘দেখ সফিক, তোর ক্লাস করার ইচ্ছা নাই, তুই পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যা, আমাকে ডিস্টার্ব করছিস কেন? আমি তো ক্লাস করছি, তাই না?’ এমনিতেই তারা বসে ছিল লম্বা ক্লাসরুমের একদম শেষ দিকে, সামনে থেকে সবাই একেবারে পিটিপ্যারেডের কায়দায় ‘পিছে-এ-এ দ্যাখ্’ স্টাইলে পেছন ঘুরে তাকে দেখতে থাকলো। কী লজ্জা! কী লজ্জা!!

জাহিদ রিকশার ভাড়া দিচ্ছিল, এর মধ্যে হাসান গিয়ে জিলাপির অর্ডার দিল। সফিক আশ্চর্য হয়ে কারিগরকে প্লেট টেনে নিতে দেখলো। সে বেশ ফুর্তিবাজের গলায় বললো, ‘জবের ব্যাপার মামা, এত রাতেও কড়হাই গরম রাখ্যাছেন যে দেখছি… ব্যাচাবিক্রি ভালই হছ্যে নাখি ?’
রাজশাহী বাসের পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম জিলাপির কারিগরকে হাসতে দেখে সফিক নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ‘কী বুইলবো মামা, কড়হাই মুনে করেন নামিয়্যা ফেলছিনু, এর মধ্যে মজমা ল্যাগে গেল। সেই মজমা ধরেন চলছে তো চলছেই… আর হামিও মুনে করেন জিলাপি ভাইজছি তো ভাইজছিই… কিছু বুলার নাই খো!’

ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের নজর গেল, জিলাপির দোকানের অদূরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে একদল মানুষ। ঠিক যেন গ্রাম্য বাজারের হাড়ভাঙ্গা তেল কিংবা যৌবনরক্ষা পোস্টাই হালুয়া বিক্রেতার মজমা জমে গেছে। কাকে ঘিরে এই মজমা, সেটা এত দূর থেকে বোঝার উপায় নেই, তবে মধ্যমণি যে-ই হোক, সে যে বেশ কায়দা মতোন আসর জমিয়ে ফেলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কী জানি কী বলছে লোকটা, উপস্থিত জমায়েত একটু পরপর হেসে গড়িয়ে পড়ছে এ ওর গায়ে। ব্যাপারটা কী? জিলাপির প্লেট হাতে নিয়ে সেদিকেই কৌতুহল ভরে তাকিয়ে থাকলো তিন জন। একটু পর নতুন এক কড়াই জিলাপি নামতেই মজমা থেকে তিন-চারজন বেরিয়ে এসে পুরো ডিশটাই তুলে নিয়ে গেল। আরে! এ তো অবাক কাণ্ড! এ কোন মজমাওয়ালা, যার মজমা দেখে এমনকি বিনা ওজনে ডিশের পর ডিশ জিলাপি হাপিস করে দিচ্ছে জনগণ? কৌতুহল চাপতে না পেরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকলো জাহিদ আর সফিক। হাসানের হঠাৎ খেয়াল হতেই সফিকের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ভাই জিলাপির দাম দিলেন না ?’
দোকানী সাথে সাথেই দরাজ গলায় উত্তর দিলো, ‘লাইকপে না মামা, পুরা দোকানই তো কিনে লিয়েছে মজমাওয়ালা ঢাকাইয়া মামা!’

ঢাকাইয়া মামা? কী বলে এই লোক! ঢাকাইয়া মামা মানে কী? জাহিদ সফিক এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তাহলে কী…? ভাবনা-চিন্তায় সময় নষ্ট করার মানে হয় না। মুহূর্তে কোথায় যেন নিঃশব্দে স্টার্টিং ফায়ার হলো, আর দুজনে ছিটকে বেরিয়ে ছুট দিল, যেন একশ মিটার স্প্রিন্টের গতিদানব দুজন। মাঝের পনের বিশ গজ দূরত্ব চোখের পলকে পার হয়ে গিয়ে জাহিদ তো রীতিমতো ধাক্কাই দিয়ে বসলো একজনের গায়ে। সে বেচারা আচম্বিতে এত বড় ধাক্কা খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল, কোনো মতে সামলে নিয়ে দ্বিগুণ রোষে পেছন ঘুরেই ধাঁই করে এক ঘুঁষি লাগিয়ে দিল জাহিদের বাম চোখের ঠিক নিচে!

একে তো খিদের চোটে শরীর দুর্বল, তার উপর এতক্ষণের পায়ে হাঁটার পরিশ্রম। জাহিদ এমনিতেই পড়ে যেত, এত জোরে ঘুঁষি খেয়ে আর তাল সামলাতে পারলো না। পা হড়কে পড়লো ঠিক পেছনে থাকা সফিকের গায়ের উপর। সফিক কোনো রকমে জাহিদের শরীরের ভার সামলে সোজা হয়ে ছেলেটাকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় নেতা গোছের দু-তিনটে ছেলে তেড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো ভীঁড়ের ভেতর থেকে। তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে পেছন থেকে কালো জিন্স আর কালো শার্ট পরা, এই রাতেও চোখে কালো সানগ্লাস আঁটা লম্বা চুলের বেশ লম্বা এক যুবক এসেই চড়াও হলো সফিক-জাহিদের দিকে, ‘এই সব কী? ওই মিয়ারা, পাইছো কি? সবখানে মাস্তানী না করলে চলে না, না? আরে মিয়া, বস্ আইছে ঢাকা থেকে, তোমাগো রাজশাহীর একটা ভালো জিনিস, বাটার মোড়ের জিলাপি বস্‌রে খাওয়াইতে আনলাম, বস্ খায়া এমন খুশি, গোটা দোকান ফ্রি কইরা দিছে, কে কত খাইতে পারো খাও, তাও তোমাদের কামড়াকামড়ি যায় না? নাহ, এই খানে আর বসা যাবে না। শালার পাবলিক রে! … শামীম ভাই, এই শামীম ভাই! দেখেন তো বিল কত হইছে! জলদি মিটায়া আসেন, পাবলিকের খাইচড়ামি শুরু হওয়ার আগেই উঠা লাগবে। বসেরে উঠতে কন!’

চারিদিক থেকে হায় হায় রব উঠলো, ‘ভাই! ভাই… এইটা কী বলেন, স্বপন ভাই, আমরা এতক্ষণ ধরে আছি, আমরা কেউ কিছু বলছি? ভাই… ভাই, উইঠেন না ভাই, বসের লগে একটা ছবি… বস্, একটু বস্…আরেকটুখানি বস্…’

ততক্ষণে জাহিদকে অতিক্রম করে সফিক প্রাণপণ চেষ্টা করছে সেই লম্বা মতোন লোকটিকে, যাকে সবাই ‘স্বপন ভাই’ বলে সম্বোধন করছে, তাকে হাত নেড়ে কিছু একটা বোঝানোর। কিন্তু স্বপন ভাই মনে হয় ভালোই বিরক্ত হয়েছেন, তিনি আর কিছুই শুনতে চান না। এক ধার থেকে ‘না না’ করেই যাচ্ছেন।

জাহিদের আর কিছুই ভালো লাগছে না। তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। কতটা তার ক্ষিদে, ক্লান্তি আর শারীরিক আঘাতে আর কতটা অব্যক্ত অভিমানের জমাট কান্নায়, অপমানে আর অভিমানে – কে তা জানে? ধুলোমাখা রাস্তায় হাঁটুমুড়ে বসে থাকা অবস্থা থেকে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সে, তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন – বস্! চকিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। অচেনা আক্রমণকারীর আঘাতে ততক্ষণে তার মুখে লালচে কিংবা কালচে দাগ পড়ে যাবার কথা, এই মুখ সে কিছুতেই দেখতে দিতে পারে না বস্‌কে। বস্ তাকে অতিক্রম করে চলে গেল, মিষ্টি একটা সৌরভ এসে ছুঁয়ে গেল তার ঘর্মাক্ত অবয়ব, তারও অনেক পরে, হয়ত মুহূর্তকাল মোটে, কিন্তু জাহিদের মনে হল অনন্তকাল, সে যেন কয়েক আলোকবর্ষ দূর থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পেলো, স্টার্ট নিয়ে থেমে থাকা মাইক্রোবাসের খোলা দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন তার… তার আদর্শ, তার দীক্ষাগুরু, স্বপ্নের নায়ক, যার কণ্ঠে প্রথম সে শুনেছিল –

তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু / তোমার মাঝেই শেষ
জানি ভালোলাগা, ভালোবাসার তুমি – আমার বাংলাদেশ!

দ্যা লিজেন্ড, দ্যা বস্ – আইয়ুব বাচ্চু!

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles

// DEBUG: Processing site: https://shangeetangon.org // DEBUG: Panos response HTTP code: 200 ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş ilbet yeni giriş betwinner melbet megapari megapari giriş betandyou giriş melbet giriş melbet fenomenbet 1win giriş 1win 1win