– রেজাউল করিম।
শিল্পীকে খুব ভালো মানুষ হতে হয়। শিল্পীদের ভুল নিয়ে সাধারণ মানুষ খুবই বিচলিত থাকেন। তাঁরা শিল্পীদের ভালো মানুষ হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার মূল্য অনেক। তাই ভুল কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। সামান্য ভুলে আকাশচুম্বী জনপ্রিয় স্টারের নামধাম ধুলায় মিশে যাওয়ার উদাহরণ হাজার হাজার আছে।
কথাগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গায়িকা কনকচাঁপার। কণ্ঠশিল্পী হতে আগ্রহীদের প্রতি এমন আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে একটি পোস্ট দেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই গায়িকা।
কণ্ঠশিল্পী হতে চাওয়া অনেকেই কনকচাঁপার কাছে বিভিন্ন সময়ে কিছু উপদেশ শুনতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, আমি আসলে উপদেশ দেওয়ার মতো কেউ নই, তবে লম্বা সময়ে গানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা বলা যেতেই পারে।
কনকচাঁপা বলেন, শিল্পী হতে আগ্রহী মানুষটিকে অবশ্যই গান ধারণ করার মতো কণ্ঠ থাকতে হবে। একজন সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন গানের ওস্তাদের কাছে গান শিখতে হবে ধৈর্যের সঙ্গে, নিয়ম মেনে। বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বানান, প্রক্ষেপণ পরিষ্কার হওয়ার মতো শিক্ষা থাকতে হবে বা সেই শিক্ষা নিতে হবে। ভেবে দেখেন, আমাদের দেশের নামকরা শিল্পীরা কখনোই তাঁর গানে গ্রামের ভাষা টেনে আনেন না। তাল বুঝতে হবে। তালকানা কখনোই গাইতে পারে না।
যাঁরা শিল্পী হতে আগ্রহী, তাঁদের অসীম ধৈর্য শক্তি নিয়ে এ পথে নামার অনুরোধও করেছেন কনকচাঁপা। শুধু তা-ই নয়, শিল্পী পেশা অন্য পেশার চেয়ে আলাদা, পয়সার হিসাব না করে তালের লয় মাত্রা বুঝলে বেশি উপকার হবে বলে মনে করেন তিনি। কনকচাঁপা বলেন, শিল্পীকে নিজের সঙ্গে, নিজের পেশার সঙ্গে অসম্ভব সৎ থাকতে হবে। কোনো রকম ওজর-আপত্তি ছাড়াই রেওয়াজ করতে হবে। শরীরের সুস্থতা অনেক বড় করে দেখতে হবে। বিনোদনকারী, গায়ক, কণ্ঠশিল্পী, শিল্পী – এগুলো একেকটা বিভাগের। আপনি কোনটা হবেন, তার ফোকাস আপনাকেই করতে হবে।
আজকাল অনেকে জনপ্রিয়তার আশায় শর্ট কাট পথ অনুসরণ করেন। অনেকে আবার নিজেদের ভাইরাল করেও আলোচনায় আনেন বলেও বিভিন্ন সময় শোনা যায়। এসব বিষয়ে কনকচাঁপা বলেন, সহজে নাম করার জন্য ছলচাতুরী মার্কা বুদ্ধি বের না করে সহজ পথে গলা সেধে ভালো করে শিখে এই পথে নামলেই বরং শিল্পী বা কণ্ঠশিল্পী হওয়ার কাজ সহজ হয়। শিল্পীদের আসলে ছলচাতুরী মানায় না। সহজে স্টার হলে একদিন ঠিক অতি সহজেই মানুষ ভুলে যায়। পাবলিক দারুণ কঠিন চিজ বটে। তারা ভালো-মন্দ খুব ভালো চেনেন। গানের বিনিময়ে পয়সার জন্য ছুটবেন না। ভালো করে গান শেখেন, অধ্যবসায় করে গান ধারণ করুন, পয়সা একসময় আপনার পেছনে ছুটবে।
ফেসবুকের এ জামানায় অনেককেই ইনবক্সে গান পাঠিয়ে প্রশংসা আদায়ের চেষ্টা করার খবরও শোনা যায়। এরপর সেসব প্রশংসাবাণী ফেসবুকে পোস্ট করে ঢোল পেটানোর চেষ্টাও করা হয়। এ বিষয়ে কনকচাঁপার সরাসরি কথা হচ্ছে, নিজের গান নিয়ে মানুষের ইনবক্সে ইনবক্সে দৌড়াবেন না। এতে মানুষ হয়তো ভালো কমেন্ট করে কিন্তু আসলে বিরক্ত হয়। জোর করে গান শোনানো যায় না বরং এতে শিল্পীকে ভিক্ষুকের মতো দেখায়। সময় নিয়ে ভালো কথার, ভালো সুরের, ভালো গান তৈরি করুন – আজ না হোক কাল সেই গান মানুষ শুনবেই। “গান খাওয়ার” উদ্দেশ্য নিয়ে গান তৈরি করবেন না। গান আসলেই মন, কান, হৃদয় শোনে-গান হোঁচট বা উষ্টা খাওয়ার জিনিস নয়।
গান স্রষ্টার কাছ থেকে পাওয়া আমানত উল্লেখ করে কনকচাঁপা বলেন, নাম করার জন্য যেখানে সেখানে গান গাইবেন না। গান আপনার সম্পত্তি নয়, স্রষ্টার দেওয়া আমানত। সেই আমানত আপনি ভুল জায়গায় ব্যবহার করবেন না। সম্মানী ছাড়া কোথাও গাইবেন না। শ্রোতাদের সামনে নিজেকে হালকা করবেন না। গান খুব অভিমানী।
গানের সঙ্গে অনৈতিক কিছু মেলাবেন, গান আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে যাবে। নিজের পেশাকে সম্মান করুন। জেনে রাখবেন, সবাই গাইতে চান, সেই ক্ষমতা পান খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। এক কোটি মানুষের মধ্যে শিল্পী হন আসলে একজন!
আজকাল শোনা যায়, ফেসবুকে অমুকে গান ভাইরাল, তমুক তো ফাটিয়ে দিয়েছে। অমুকের গান কোটি ভিউ হয়ে গেছে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ, স্পষ্ট সুরে গান গাইবার পরামর্শ দিয়েছেন কনক চাঁপা। তিনি বলেন, ফেসবুকে গান ভাইরাল করার চেষ্টা না করে আকাশে-বাতাসে ছড়ানোর চেষ্টা করুন। ফেসবুক-ইউটিউবের জনপ্রিয়তা আসল জনপ্রিয়তা নয়। যখন দেখবেন পানের দোকান, পাড়ার অনুষ্ঠানে আপনার গান বাজছে, তখন বুঝবেন আপনার গান সত্যিকারে ছড়িয়ে গেছে। নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে কী লাভ? স্পষ্ট উচ্চারণ স্পষ্ট সুরে গান করুন। গানের কথা গানের মাধ্যমে শ্রোতাদের কানে পৌঁছে দেওয়া আপনার দায়িত্ব। গানের কথা তো আর লিখে লিখে শ্রোতাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবেন না।
কণ্ঠশিল্পী হতে আগ্রহী ব্যক্তিদের উদ্দেশে কনকচাঁপা আরও বলেন, গানকে রাজমুকুট না পরাতে পারেন কিন্তু তাই বলে তাকে স্যান্ডো গেঞ্জি পরাবেন না। গানের উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যান। গানকে নিচে নামাবেন না। ভালো করে নিজে শুনে দেখেন আপনার কণ্ঠে মানুষের মনে প্রশান্তি আনার মতো সুর আছে কি না! সত্যি সত্যিই নিজের কণ্ঠের প্রতি সুবিচার করুন। সে রকম কণ্ঠ না হলে গান গেয়ে মানুষকে জ্বালাবেন না! গান গাইতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। ভালো শ্রোতাদেরও অনেক সম্মান আছে।
সবশেষে কনকচাঁপা জানান, তাঁর কথাগুলো কারও মনে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়। কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিতে অনুরোধ করেছেন তিনি। তবে শিল্পী হতে আগ্রহী সবার যেন ভালো ইচ্ছেগুলো পূরণ হয়, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গায়িকা।