– শহীদুল্লাহ ফরায়জী।
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন আলী। সুরের বাগানে বসবাসকারী তাঁর আত্মা উড়াল দিয়েছে ঊর্ধ্ব গগনে। সুর ঘেরা আবেষ্টনী থেকে আলাউদ্দিন আলী মুক্তি পেয়েছেন। এখন তিনি স্বর্গের উচ্চতায় সমুদ্রের গভীরতায় ইচ্ছামত বিচরণ করতে পারবেন। আবেগ হৃদয় এবং সঙ্গীতকে অতিক্রম করে নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন প্রকৃতির রহস্যের কাছে। খ্যাতি জনপ্রিয়তা প্রশংসা অর্থ বিত্ত মোহ ভালোবাসা সবকিছু কি পরিত্যাগ করার সুযোগ পেয়েছেন।
এখন তিনি বিশাল শূন্যতায় পরিভ্রমণ করবেন। গভীর শূন্যতার সীমাহীনতায় ঐশ্বরিক সুরের অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবেন। আত্মাকে সুরের সঙ্গী করে ছায়াপথের উপর দিয়ে হেটে যাবেন।
আলাউদ্দিন আলী সমগ্র জীবন সুরের সমুদ্রে সংগীতের গভীরতর স্বপ্ন বয়ন করেছেন। আত্মার নীরবতায় অবতরণ করে সুরের বৈচিত্র অনুসন্ধান করেছেন।
আলাউদ্দিন আলী ছিলেন সুরের জাদুকর। তিনি হৃদয়ের জানালা দিয়ে মানুষের আবেগের গোপন আকাঙ্ক্ষা দেখতে পেতেন। ফলে মানুষের অন্তরাত্মা স্পর্শ করার অভাবনীয় সাফল্য জুটেছে তাঁর কপালে। হৃদয় থেকে সুর তুলে সুরের যাদু দিয়ে তিনি খ্যাতির উচ্চতায় অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। সুরের রংধনু থেকে সুর ছিনিয়ে নিয়ে নৈপুণ্যের সাথে সংগীতে ফুল ফুটিয়েছেন।
আমি আলাউদ্দিন আলীকে অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর গভীরতর বেদনা বা অধিকতর আনন্দ সবকিছু পূর্ণতা পেতো সঙ্গীত এর মাঝে। বেদনায় ভারাক্রান্ত দেখেছি, আনন্দ বেদনার মাঝে সুরের ঐশ্বর্য অনুসন্ধানে মনোযোগী হতেও দেখেছি। আলাউদ্দিন আলী সুরের চারণভূমিতে অগণিত সুর বপন করেছেন। বাংলাগানের চারপাশ উচ্চতম সঙ্গীতে ভরপুর করে দিয়েছেন।
তিনি প্রথমে ছিলেন বাদ্যযন্ত্রী। তারপর প্রবেশ করেছেন সুরের গৃহে, তারপর সুরের গৃহের গৃহকর্তা সেজেছেন তারপর সুরস্রষ্টা হয়েছেন।
আলাউদ্দিন আলী হাজার হাজার গানে সুরারোপ করেছেন। তিন সৃষ্টিশীলতা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি প্রতিটি গানে সুরের বৈচিত্র দিয়ে একটা চিত্রকল্প গড়ে তুলেছেন। রোমান্টিকতা তাকে সব সময় প্রেরণা যুগিয়েছে। তার অন্তর সকল সময় নতুন অনুভূতি নতুন সুর দ্বারা প্লাবিত হতো।
ও আমার বাংলা মা তোর, সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ, আছেন আমার মোক্তার, যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, হায়রে কপাল মন্দ, ভালোবাসা যত বড়, কেউ কোনদিন আমারেতো কথা দিল না, জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, এমনও তো প্রেম হয়, যেটুকু সময় তুমি কাছে থাকো, চোখের নজর এমনি কইরা এমন বহু কালজয়ী গানের সুরকার আলাউদ্দিন আলী।
আলী ভাই সঙ্গীতে তার একটা নিজস্ব প্যাটার্ন বা নিজস্ব রীতি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সুরশৈলীর গঠন ছিলো একেবারে ভিন্ন মাত্রার। তাঁর গানের সুর শুনেই তাকে আবিষ্কার করা যেতো।
হৃদয় স্পর্শ করার রসদ জোগাড় করার জন্য আকুল পিয়াসী ছিলেন তিনি, আমি গান করতে গিয়ে দেখেছি। লিরিক্স পুরো মাত্রায় পছন্দ না হলে সুর করতে আগ্রহী হতেন না। প্রবাদপ্রতিম গীতিকাররা আলী ভাই’র সাথে কাজ করেছেন আমি কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছি। প্রচলিত ধারণার কোন কিছুই আলী ভাইকে আকৃষ্ট করতে পারতো না। আমি মূলত অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছি। আলী ভাইয়ের সমগ্র জীবন সিনেমার সাথে জড়িত। জহুরির চোখ তাঁর। যে শিল্পীদের মাঝে ভিন্নমাত্রার প্রতিভা দেখতে পেরেছেন তার সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
আমার মাঝে তুমি এখন, স্বর্গের চেয়েও বেশি আপন-এই একটি সিনেমার গান দিয়ে আলী আলী ভাই’র সাথে আমার গানের অভিযাত্রা। তারপর পুরো সিনেমার গান লিখলাম আমি। প্রেম মানে ভিতর বাহির পুড়ে যাওয়া.. আনন্দ সহকারে সুরের রাজ্যে অবগাহন করে সুর চূড়ান্ত করে বললেন এ গানের শিল্পী অবশ্যই সাবিনা ইয়াসমিন। এছাড়াও এন্ড্যু কিশোর, কোনাল, পলাশ এবং ফারজানা আলির কন্ঠে গান করেছি আলী ভাই’র সুরে। আলী ভাই’র সাথে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি। আলীভাই’র নিজস্ব ধারণা, ভাবনা অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। মানুষের জীবন রহস্যবৃত কিন্তু তিনি কেন জানি অনেক রহস্য আমার কাছে উন্মোচিত করেছেন। জীবনের অনেক ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করেছেন। সংসার জীবনের আভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন নিয়ে কথা বলেছেন। দ্বন্দ্ব-সংঘাত পূর্ণ জীবনেও সংগীতের ঐশ্বর্য থেকে নিজেকে কখনো বিমুক্ত করেননি।
আলাউদ্দিন আলী তার স্বপ্নের জীবনকে প্রতিমুহূর্তের ভাবনা দিয়ে গড়ে তুলেছেন। সংগৃহীত অভিজ্ঞতা লালন করে তিনি নিজেকে সংগীতের এই উচ্চতায় নিয়ে এসেছেন। বাবা নাম রেখেছিলেন আলাউদ্দিন মিয়া। নিজেকে সংগীতের আকাশের ধ্রুবতারা করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে-এই ভাবনায় তার ভেতর থেকে বার্তা আসলো। নিজেই নিজের নামকরণ করলেন আলাউদ্দিন আলী। এই গল্প বলার সময় আনন্দের সাথে সাথে চোখে উষ্ণ অশ্রু লুকিয়ে থাকতে দেখেছি। কোলাহলমুখর জীবনের কথা শুনেছি বেদনার্ত জীবনের কথা শুনেছি।
তিনি অনেক শিল্পী গীতিকার সুরকারের গুনকীর্তন করেছেন আবার অনেক নিম্নমানের গানের প্রশ্নে বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন। বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পীদের কন্ঠে গান শুনে অনেক সময় বিস্ময়কর চাঞ্চল্য অনুভব করতেন।
এত জাতীয় পুরস্কার এত সম্মাননা এত প্রশংসা তারপরও তার মাঝে আমি অতৃপ্ততা বিরাজ করতে দেখেছি। আক্ষেপ যন্ত্রণার মাখামাখি দেখেছি। তিনি জীবনের ক্ষণস্থায়ী আনন্দকে চিরস্থায়ী করতে চেয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ বেদনাকে বুকে লালন করেছেন। তিনি হৃদয়ের গভীরে অদৃশ্য একটা চোখ রেখেছেন যা দিয়ে চারপাশকে পরখ করতে চেয়েছেন। তিনি বারবার বলতে চেয়েছেন সব গান গান হয় না। যেমন সব বলা গল্প হয় না। তিনি সংগীতের আভিজাত্য লালন করতেন। তাঁর কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করা ছিল কঠিন। স্বল্পকালের জীবনে বহুজনের গান করেছেন।
আলাউদ্দিন আলী সৌভাগ্যবান।। সুরের পরশ পাথর তাকে ধরা দিয়েছিল। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকুল আকাঙ্ক্ষা তাঁকে এতদূর নিয়ে এসেছে। মৃত্তিকা থেকে রস সংগ্রহ করে ক্রমাগত সৌভাগ্য সংগীত রচনা করেছেন। তিনি গানে সুর দিয়ে অনেক সময় বুঝতে পারতেন কোন গান তাঁর ভবিষ্যতে চিহ্ন বহন করবে। সংগীতের গুপ্তধন উদ্ধারে তিনি ছিলেন দ্রুত ধাবমান। তিনি সঙ্গীতের অনির্বাণ অগ্নিশিখা থেকে শিখা সংগ্রহ করে নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করেছেন।
আলাউদ্দিন আলী বাংলা গানের অন্যতম বার্তাবাহক। তিনি অনেক গানে সুরের ঐশ্বর্য বিতরণ করেছেন, মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়েছেন, সৌন্দর্যের দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। সংগীত ছিল তাঁর অনুভূতি, সঙ্গীতই ছিল তাঁর উচ্চাকাঙ্খার আশ্রয়স্থল।
মানুষের ভালোবাসা অর্জনের ভয়াবহ ক্ষমতা ছিল আলাউদ্দিন আলীর। কি এক অজানা আকর্ষণে মানুষকে মুগ্ধ করে রাখতেন। রোগে জীর্ণশীর্ণ থেকেও আত্মার বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলতেন। গত কয়েক বছর স্পষ্ট কথা বলতে পারতেন না কিন্তু হৃদয়ের গভীরতায় সুরের কণ্ঠস্বর প্রকাশ করতে চাইতেন। আবার সুর করবেন আবার জমবে মেলা এমন আকাঙ্ক্ষাও আলী ভাই’র মাঝে প্রত্যক্ষ করেছি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করতে চাইতেন।
করোনা কালীন সময়ে যতবার কথা হয়েছে ততবার বাসায় যাবার তাগিদ দিয়েছেন, দীর্ঘদিন দেখা না হওয়ার জন্য আক্ষেপ করেছেন। আমি বারবার কথা দিয়েছি কিন্তু কথা রক্ষা করতে পারেনি। আলী ভাই আর কোনদিন দেখা হবে না, কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকব আপনাকে পরিত্যাগ করতে পারবোনা। আপনার জন্য আমার ভিতরের আবেগ অনুভূতি বিলুপ্ত হবে না কোনদিন। আপনার সুরের স্মৃতি সম্বলিত উচ্চতম ভাস্কর্য আমার চোখের সামনে থেকে কখনো আড়াল হবে না। সংগীতের শ্বাস-প্রশ্বাস আপনার স্মৃতি বহন করবে বহুকাল।
বিশ্ব বিখ্যাত সাহিত্যিক কহলীল জিবরান বলেছেন ‘সেই মহৎ যে বাতাসের শব্দকে সঙ্গীতে পরিণত করে এবং তাকে নিজের পছন্দের গানের চেয়েও অধিকতর মধুর করে তোলে। কাজ হচ্ছে ভালোবাসা যা দৃশ্যমান করে তোলে সবকিছুই।
আলী ভাই বাতাসের শব্দকে সঙ্গীতে পরিণত করে মহৎ হয়েছেন। তাঁর সকল কাজকে দৃশ্যমান করেছেন।
আলাউদ্দিন আলী পরপারের টিকিট কেটে যাত্রা শুরু করেছেন- যাত্রা শুভ হোক।
লেখক: গীতিকার
১০ আগস্ট ২০২০।