– তানভির হোসেইন।
প্রায় বারো-তেরো বছর আগের কথা। তখন আমি অন্য একটি ব্যান্ড এ বাজাতাম। পুরান ঢাকার কোনো এক মহল্লায় আমাদের ব্যান্ড এর শো। এক পাড়াতো ছোট ভাই এর মাধ্যমে শো’টি পেয়েছিলাম। এই ছোট ভাইয়ের পুরান ঢাকার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু’র মামাই হলো অনুষ্ঠান এর উদ্যোক্তা। মামা যথারীতি ব্যবসায়ী এবং তার অর্থায়ন ও সার্বিক সহযোগীতায় এই আয়োজন। তাই মামার উৎসাহের কোনো কমতি নেই। তিনি একবার একে ডাকছেন তো ওকে বকছেন। সে কি হম্বি-তম্বি !!
অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন। সব মিলিয়ে মামা ভীষণ উত্তেজিত। একমাত্র ছেলের সুন্নতে-খাৎনা বলে কথা !! যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে রাত বারোটার পর অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমরা একের পর এক গান করে যাচ্ছি। দর্শক-শ্রোতারা খুব ভাল উপভোগ করছে এবং উদ্দাম নৃত্যকলার নব্য-আবিষ্কৃত বিভিন্ন মুদ্রা পরিবেশন করছে। হঠাৎ একটি গানের মাঝপথে মামা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং ইশারায় তাৎক্ষনিক গান বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দিলেন।
মামার এই আচরণে আমরা সবাই ভীষণ অবাক হলাম এবং কি হয়েছে জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এবার মামা সরাসরি স্টেজে উঠে এলেন এবং তাঁকে খুবই চিন্তিত দেখা গেল। সবার আগে তিনি আমাদের কীবোর্ড প্লেয়ার এর কাছে গেলেন এবং বললেন – “মামা একবার বাজাও দেহি তোমার মেশিনডা”? কীবোর্ড প্লেয়ার তার “মেশিন”টি বাজিয়ে শোনালো এবং মামা শুনে বললেন – “ঠিকই তো আছে দেখবালাগছি”। এবার মামা আমাদের গীটারিস্ট এর কাছে গিয়ে বললেন – “মামা বাজাও দেহি তোমার যন্ত্র’ডা”? গীটারিস্ট খানিকটা বাজিয়ে শোনালো, এবং মামা মনোযোগ সহকারে শুনে রায় দিলেন
“এইডাও তো হালায় ঠিকই আছে দেখতাছি” !!! এবার মামা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আমার দিকে (অর্থাৎ ড্রামার এর দিকে) এগিয়ে এলেন এবং বললেন – “দেহিতো ভাইগ্না তোমার ঢোলে দুইডা বারি দেও তো”? এবার আমিও কয়েক সেকেন্ড বাজালাম এবং খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনে মামা রায় দিলেন – “কিরে হালায় এইডাও তো ঠিকই আছে। এবার সবশেষে বেজ গীটারিস্ট এর দিকে গিয়ে যথারীতি বাজাতে বললেন, বেজ গীটারিস্ট তার গীটারের মোটা মোটা তারে কয়েকটা টোকা দেওয়া মাত্রই মামা চেঁচিয়ে উঠলেন, – “পায়া গেছি হালায় পায়া গেছি (মামার চোখে মুখে আবিস্কারের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে) হেল্লিগাইতো কই শালার ভোঁ ভোঁ করে কোনডা? এরপর মামা আমাদের বেজিস্ট কে একজন অভিজ্ঞ মানুষের মতো লেকচার দিলেন – “ভাইগ্না তুমি স্টেজ তন নাইম্মা যাওগা,
তোমার যন্ত্র নষ্ট হইয়া গেছেগা হেইডারে ঠিক কইরা লইয়া আহো গা”, আর আমাদের সবার উদ্দেশ্যে তাকিয়ে বললেন – “মিয়া তোমরা গান বাজনা করো মাগার এইডা বুঝবার পাল্লা না, আর তোমাগো একজনেরও কানে গেল না যে, একটা যন্ত্র দিয়া নষ্ট ছাউন্ড বারাইতাছে”। মামার কথা শুনে আমারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। সম্বিত ফিরে পেতেই আমাদের প্রচন্ড হাসি পেল। কিন্তু মামার ভয়ে কেউ হাসতেও পারলাম না, পাছে মামা মাইন্ড করে বসে। যাই হোক, অনেক চেষ্টার পর মামাকে কোনো মতে বোঝাতে পারলাম এইটার নাম বেজ গীটার। এটা দিয়ে এইরকম মোটা গুম গুম অথবা ভোঁ ভোঁ শব্দই বের হয় এবং এটা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের মতোই একটি অপরিহার্য বস্তু। অবশেষে, মামা অনেকটা নিমরাজি হয়েই বেজ গীটার সহ আমদের প্রোগ্রাম চালানোর অনুমতি দিয়ে বাধিত করলেন। রাত প্রায় তিনটার দিকে আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। একটা মজার অভিজ্ঞতা নিয়ে সে রাতে আমরা সবাই বাড়ি ফিরলাম।
ছবি ও মডেল – তানভির হোসেইন
অলংকরন – মাসরিফ হক