asd
Friday, November 22, 2024

বৃষ্টি এলে আজও মনে পড়ে…

– মোশারফ হোসেন মুন্না…

শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরলে মনে এমনিতেই নিরঙ্কুশ ভাবনার অনুভূতি জন্মায়। আর আমার হাতে কলম উঠে আসে! শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভেজার আকুলতা থাকলেও উদ্যমটি আর নেই। ব্যস্ত থাকলে হয়তো চোখ মেলে দেখারও ফুরসৎ মেলে না। আজকে একটু ব্যস্ততা কম, তার উপর বৃষ্টি নিয়ে লেখার আদেশ বর্তানো আমার উপর তাই ব্যালকনিতে বসে অনেকদিন পর বৃষ্টি দেখা হলো। যদিও বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন ধরে তবে তেমন আগ্রহ নিয়ে দেখা হয়নি যেমনটা আজ হলো এমন হাওয়া মুখর তুমুল বৃষ্টি মনটাকেই এলোমেলো করে দেয়! কতো কথা মনে পড়ে! কতোকিছু…

রুপগঞ্জের শীতলক্ষা-তীরবর্তী অঞ্চলে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। ওখানে বর্ষার রূপ অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে ভীষণ-রকম আলাদা। বিপুল বর্ষা, মাঠঘাট ভাসানো কূল-কিনারাহীন বর্ষা। আর বৃষ্টিতে ভেজা তখন কেবল একবেলার রোমান্টিসিজম নয়, বরং নিত্যদিনের সঙ্গী। বর্ষাকালের এমন একটি দিনও বোধহয় যায়নি, যেদিন আমরা বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করিনি। শৈশব-কৈশোরের যে কয়টি জিনিসের সঙ্গে আমার প্রেম, বৃষ্টি তাদের একজন। এই প্রেম ছিলো আরো বহু-বহুদিন। তারুণ্য আর যৌবনও কেটেছে বর্ষার আলিঙ্গনে আর উন্মাদনায়।
এখনও সেই প্রেমটি আছে হয়তো, তবে স্মৃতি হয়ে। আলিঙ্গন নেই, নেই উন্মাদনাও। অন্যান্য যে-কোনো প্রেমের মতোই বৃষ্টি দেখেও তাই কেবল স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। আজ আবার উপলব্ধি করে উঠলাম – মানুষ আসলে সম্পর্ক নিয়ে বাঁচে না, বাঁচে সম্পর্কের স্মৃতি নিয়ে। কত গান আর কবিতা যে লেখা হয়েছে বৃষ্টি নিয়ে, তার হিসেব নেই। বৃষ্টি যে আমাদের জীবনের কতোটা প্রিয় আর কাঙ্ক্ষিত সেটি বোঝা যায় এই গান ও কবিতাগুলোর বিপুল জনপ্রিয়তা দেখেই। ছোটবেলায় একটা ছড়া শুনতাম বৃষ্টি নিয়ে; হয়তো লোকছড়া, মানুষের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে সেটা নানারকম রূপ পেয়েছে। আমার মনে পড়ছে এটা –
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এলো বান,
শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে
তিন কন্যে দান।
এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন
এক কন্যে খান
আরেক কন্যে গোস্বা করে
বাপের বাড়ি যান।
ছড়াটি শুনেছি মায়ের মুখে, মা শুনেছেন তাঁর মা’র মুখে। কত কাল আগে, কে যে এটা লিখেছিলেন, কেউ জানে না। কী যে এর মানে, তাও বোঝা ভার। তবু, বৃষ্টি মানেই এই ছড়া, এই নস্টালজিয়া। মজার ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথও এটি ‘শুনেছেন’ ছোটবেলায়, আর তার স্মৃতি ধরে রেখেছেন আরেকটি কবিতায় –
দিনের আলো নিবে এল সুয্যি ডোবে ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ।
মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা বাজল ঠঙ্‌ ঠঙ্‌।
ও পারেতে বিষ্টি এল ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলার গান –
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।

কবে বৃষ্টি পড়েছিল, বান এল সে কোথা –
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল, কবেকার সে কথা! সেদিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘটাখানা!
থেকে থেকে বাজ-বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা!
তিন কন্যে বিয়ে করে কী হল তার শেষে!
না জানি কোন নদীর ধারে, না জানি কোন দেশে,
কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।

বোঝাই যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ নিজেও তার ছেলেবেলায় ছড়াটি শুনেছিলেন, যেটি তাঁর কাছে ছেলেবেলার গানের মর্যাদা পাচ্ছে! বোঝা যাচ্ছে এ-ও, বহুকাল আগে থেকেই এটি বাংলাদেশে প্রচলিত ছিলো। কে লিখেছিলেন এই ছড়া ?
কত কাল আগে? কোন গুণের জন্য ছড়াটি শত শত বছর ধরে শিশু-কিশোরদের আনন্দের উৎস হয়ে উঠছে আর বড়োদের করে তুলছে নস্টালজিক ? বৃষ্টির প্রসঙ্গই কি ছড়াটিকে এমন অমর করে তুললো ? একই কারণে বৃষ্টির গানগুলোও কি এমন বিপুলভাবে আদৃত হয়ে উঠেছে বাঙালির কাছে ? বৃষ্টি কি এতটাই প্রিয়, এতটাই মধুর ? বৃষ্টি নিয়ে কিছু বলতে গেলেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র কথা মনে পড়ে যায় –

এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে…আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারই জন্যে তৈরি এরকম লোনলি-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস। এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্তকাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ, কতোদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’, সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে। আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই। কতোবার যে পড়েছি এই গল্প! কতোবার শুনিয়েছি সবাইকে, তবু পুরোনো হয় না! আর যতোবার পড়ি, ততোবারই মন খারাপ হয়ে যায়।

বৃষ্টির বাড়ছে। নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিতে ধুঁয়ে-মুছে যাচ্ছে চরাচর। এই শহরের সমস্ত কান্তি, জঞ্জাল, পাপ, বেদনা, আর হাহাকার কেন ধুঁয়ে মুছে যায় না? কী তুমুল, অহংকারী, একরোখা, জেদী বৃষ্টি! মনে হয়, আমাদের গ্রামে ঠিক এরকম বৃষ্টি হতো। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই সরল-সুন্দর শৈশবে, যদিও জানি আর কোনোদিন ফেরা হবে না… সব মানুষই ‘একবার পায় তারে পায় নাকো আর’।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles