– শাহরিয়ার খান সাকিব।
নচিকেতার পুরনো দিনের গানের একটি কলি ছিলো, ‘বাংলার গানে যার নামেই বসন্ত, তিনিই গায়ক সুরকার হেমন্ত’।
হেমন্ত মানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হলেন বাংলা গানের সেই কিংবদন্তীর নাম, যার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নচিকেতা তার গানটিতে। আজ সেই কিংবদন্তী সুরস্রষ্টার জন্মদিন। সেই বিশেষ উপলক্ষে ইন্দিরাগান্ধী কালচারাল সেন্টার হাই কমিশন অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়া সহযোগে তার ১০০ বছর জন্মদিন পালন করছেন আজ ১৬ই জুন। ঢাকা ইন্ধিরাগান্ধী কালচারাল সেন্টার থেকে তাদের ফেসবুকে লাইভ করবে। তাদের ফেসবুক লিঙ্ক (www.facebook.com/IndiraGandhiCulturalCentre) সন্ধ্যা ৭.৩০ মিঃ সময় অনুষ্ঠানে পারর্ফম করবেন সাদী মুহাম্মদ ও ড. অমিতাভ চাঁন্দা। অনুষ্ঠানটি দেখার আবেদন রইলো। কোন এক গায়ের বধুর কথা তোমায় শোনাই শোনো উপকথা নয় সে নয়, সুকান্তের ‘রানার’, শোনো বন্ধু শোনো, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা, খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার, এই তোমাদের পৃথিবী, ও নদীরে একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে’ একের পর এক মাস্টারপিসে কন্ঠ দিয়ে গিয়েছিলেন এই অমর শিল্পী। বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেমের কাহিনী নিয়ে হিন্দি ভাষায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী হলে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রণসঙ্গীত হিসেবে বিবেচিত ‘বন্দে মাতরম’ গানটি হিন্দি ভাষায়ও অসাধারণভাবে গেয়েছিলেন তিনি।
পেশাগত জীবনে একজন প্রকৌশলী হলেও সঙ্গীতই ছিলো তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা। সেই সুরের সাধনাতেই সারা জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি সাদামাটা জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে। একসময় তাঁর পরিচিতি হয় ‘মহানায়ক এর কন্ঠস্বর’ বলে। কারণ বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমারের লিপসিং দেয়া অধিকাংশ গানের গায়ক ছিলেন তিনিই।
আজকের প্রজন্ম অধিকাংশই এসব গানের প্রতি উন্নাসিকতা প্রদর্শন করে থাকেন। তাঁদের ঝোঁক পপ, রক, আর হেভী মেটালের দিকে। মেটালিকা বা গানস এণ্ড রোজেস তাদের কাছে যতটুকু সমাদৃত, স্বর্ণযুগের এই কিংবদন্তী শিল্পীদের গানগুলো ততটাই অপরিচিত। নিজেদের অজান্তেই হাতের কাছে থাকা সমৃদ্ধ এক শিল্পভাণ্ডার হতে ক্রমাগতভাবে নিজেদের বঞ্চিত করে চলেছেন তারা এভাবেই।
আজ হেমন্ত নেই। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া গানগুলো আমাদের মনে সুরের যাদুর পরশ বুলিয়ে যাবে যুগ যুগান্তর ধরে। এই কিংবদন্তী শিল্পীর জন্মদিনে রইলো সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে গায়ক বা সুরকার ভাবলে কিছুই বলা হয় না। তিনি সময়ের একটা অবিনশ্বর দাগ, এমন এক সাংস্কৃতিক উপস্থিতি যিনি যুগের মুদ্রাভঙ্গকে বিপুল প্রতিভায় ইতিহাসের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত করেন। কী যে অলৌকিক সমাপতন! ১৯৪৭ সালে, আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বছরে, চালু দেশাত্মবোধের রমরমার মধ্যে তিনি গেয়েছিলেন কিংবদন্তীর সমান ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’। এই গান যা ইতিহাসের বিদ্যুল্লতাকে অন্দরের মলিন উনুনে টেনে নিয়ে যায় তা বাঙালির স্বাধীনতার ফাঁকি ও চল্লিশ দশকের ট্রমাকে কণ্ঠের কুসুমকোরকে ধারণ করে আছে। কী এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে পুড়তে পুড়তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীর সাহচর্যে রচনা করেন সময়ের যুগপৎ প্রাচীন ও নবীন মলাট। ১৯৫৫ সালের ‘শাপমোচন’তো সভ্যতার রূপান্তরের ইতিকথা জনপ্রিয়তার মোড়কে। এই যে একটি সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতা, গ্রামীণ সমাজ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা পর্বে নগর সভ্যতার প্রণয়কটাক্ষে সায় দিল, আধুনিকতার দিক থেকে দেখলে তা অহল্যার শাপমোচনের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু গান যা পালুশকারের অভিজাত সুরবিস্তারে ‘চন্দ্রচূড় জটাজালে আছিলা যেমতি’ বদ্ধ ছিল তা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কত শাস্ত্রমুক্ত, কত সরল হতে পারে, হেমন্তের গাওয়া ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ প্রমুখ বুঝিয়ে দেয় এই ঝড় বস্তুত সমাজবদলের রূপক। এসব আজ মনে করিয়ে দেয় হেমন্তের কথা। ভালো থাকুক হেমন্ত ঐ পাড়ে। শুভেচ্ছা শতবছরে।