– সুব্রত মণ্ডল সৃজন।
প্রিয় সঙ্গীতপ্রেমী, নন্দী ভক্ত। আজ আপনাদের জন্য সঙ্গীতাঙ্গন এর যে উপহার তা আমাদের সঙ্গীত আকাশে কয়েকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মাঝে একটি নক্ষত্রের কথা, যে নক্ষত্রটি গত এক বছর পূর্বে সংগীতের গগন থেকে ঝরে যায় কিন্তু এ নক্ষত্র ঝরে গেলেও তার দেয়া আলো চির অম্লান হয়ে থাকবে সংগীত গগনে।
হ্যাঁ, এই নক্ষত্রটি হল আমাদের প্রাণপ্রিয় শিল্পী, আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী সুবীর নন্দী। যাকে কোন উপাধি দিয়ে সীমাবদ্ধ করা উচিত হবে বলে মনে করি না। তাই আজ তাকে নিয়ে যে কথাগুলো বলা হবে, যা জানা হবে হয়তো তা পূর্বে কখনো হয়নি জানা, হয়নি বলা। আজ বলবো সুবীর নন্দীর ভিন্ন কোনো গল্প তা কোন দিনকে উপলক্ষ করে নয়। এ গল্প যেন চির সবুজ অতীত স্মৃতি যা নিত্যই সুগন্ধি ছড়ায়।
আর সুবীর নন্দীকে নিয়ে এই স্মৃতিচারণ করেছেন যিনি তিনি হলেন তাঁর নিকট থেকে নিকটতম বন্ধু বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী লীনু বিল্লাহ।
তাহলে চলুন জেনে নেই তাদের বন্ধুত্বের সেই গল্প যে গল্পে জড়িয়ে আছে সুবীর নন্দীর বাস্তব জীবনের অংশ…
– শুভ বিকাল! কেমন আছেন ?
– আমি ভালো আছি, তুমি ভালো আছো ?
– হ্যাঁ আপনাদের দোঁয়া, মালিকের কৃপায় ভালো আছি। সুবীর নন্দীর সাথে তো আপনার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল, যিনি আমাদের মাঝ থেকে দেহ রেখেছেন এক বছর অতিক্রান্ত হল। আজ আপনার থেকে আপনাদের সম্পর্কের কিছু কথা শুনতে চাই যা সুবীর নন্দীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
– হ্যাঁ অবশ্যই।
– আপনাদের পরিচয় কিভাবে ?
– ওর সাথে আমার পরিচয় ১৯৬৪ সাল থেকে। আমি একবার কচিকাঁচার মেলাতে গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলে সেদিনই ওকে আমি দেখলাম প্রথম। ও তখন হাফপ্যান্ট পড়তো। বয়সের দিক দিয়ে হয়তো দু-এক বছরের জুনিয়র হবে কিন্তু আমরা সেইম ছিলাম এবং ওই অল্প বয়সেই সে তুখার হারমোনিয়াম বাঁজিয়ে গান গাইলো আমাদের সামনে, আমরা অবাক হয়ে গেলাম! ওই তখন থেকেই আমাদের হৃদ্যতা হলো পরিচয় হলো।
– তারপর ?
– তারপর তো আমি ঢাকায় চলে আসলাম, তখন তো আর এমন কমিউনিকেশন সিস্টেম ছিলো না।
– দ্বিতীয়বার কবে দেখা হয় তাঁর সাথে মনে পড়ে কি কিছু স্মৃতি ?
– হ্যাঁ! ১৯৭১ এ দ্বিতীয়বার ঢাকায় দেখা হলো ‘৭২-এ ঢাকায় আসলো এবং এই শুরু হলো আবার আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধন আরো কঠিন ভাবে।
– পারিবারিকভাবে আপনারা কেমন ছিলেন ?
– ও আর আমার ফ্যামিলি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম এবং এমন অবস্থা যে আমার বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে সুবীর না আসলে অন্যরকম মানে চিন্তাই করা যায় না।
– আচ্ছা বন্ধুদের ক্ষেত্রে তো বন্ধুকে অনেক সময় ভিন্ন নামেও ভালোবেসে ডাকা হয় আপনাদের মাঝে এমন কোন ভালবাসার নাম ছিল কি ?
– হ্যাঁ ঠিক! ওকে আমরা ‘গোঁসাই’ বলে ডাকতাম, খুব ভালোবাসার নাম এবং এমন হতো যে বলতাম -এই গোঁসাই তুমি অনেকদিন যাবৎ আমাদের এইতা খাওয়াও না, ওইতা খাওয়াও না, এরকম অনেক আবদার ছিল গোঁসাই-এর কাছে…।
– আপনারা উভয়েই যেহেতু শিল্পী, ঘরোয়া আয়োজন সম্পর্কে যদি কিছু বলেন –
– তা তো বটেই। মাসের মধ্যে দুইটা-তিনটা প্রোগ্রাম হতো আমার বাসায়। সুবীর আসতো আরও অনেক অনেক শিল্পী আসতো। তবে ‘সুবীর ওয়াজ দা মেইন’ মানে সুবীর ছিলো মধ্যমণি। এভাবেই চলতে থাকে…
– ভালো লাগছে! তারপর ?
– তারপর ‘৯৭-এর দিকে হঠাৎ করে ও অসুস্থ হয়ে পরলো, কোমরে অসুবিধা, ডায়াবেটিস ধরা পড়লো। তখন ওর কাছে গেলাম আমি ও আমার ওয়াইফ ও বলল গোঁসাই আমাকে বাঁচাও, আমি খুব অসুস্থ! এই আমরা বাসায় দৌড়ে এসে শুরু করলাম যে ওর জন্য কিছু করবো। সেই সাথে জয়েন করলো তপন চৌধুরী, হাসান চৌধুরী, রফিক ভাই এই পাঁচ-ছয়জন মিলে আমরা শুরু করলাম এরপরতো পুরো বাংলাদেশ ঝাঁপিয়ে পড়ল। তবে শুরুটা আমরাই করেছিলাম। তারপর সকলের দোয়ায় ভালোবাসায় রোগমুক্ত হলো। তারপর আবার গান আবার আমার বাসায় গান আড্ডা…
– আপনার বাসায় শেষ প্রোগ্রাম কবে হয়েছিল ?
– ২০১৮ সালের ৬ মে আমার বাসায় শেষ প্রোগ্রাম করে গেলো। তারপর চলে গেলো আমেরিকায় আবার অসুস্থ হয়ে গেলো এই শুরু হলো ওর অন্তিম যাত্রার পূর্বাভাস! আর ২০১৯ সালের ৭মে পুরো এক বছর পরে চলে গেলো আমাদের সঙ্গীতরত্ন!…
এরমধ্যে তো অনেক খুঁনসুটি হয়েছে, অনেক চলাফেরা হয়েছে, গান হয়েছে…
– আমেরিকা যাবার পূর্বে আর কিছু ?
– ২০১৮ সালে যখন আমেরিকায় যায় তখন একটি গানের সুর করে ঢাকার উজ্জ্বল স্টুডিওতে দিয়ে গেছে।
– সুবীর নন্দী আপনার বন্ধু হিসেবে কেমন বন্ধু ছিলো বলে মনে করেন ?
– ও তো আমার সাংঘাতিক প্রিয় বন্ধু ছিল। গান-বাজনার ব্যাপারে সব সময় ও আমার সাথে কথা বলতো, আমি ওর সাথে কথা বলতাম। কোন একটা মেয়ে বা ছেলে ভালো গাইলে আমরা পরস্পরের আলোচনা করতাম যে এই ছেলেটার বা মেয়েটার ভবিষ্যৎ আছে…মানে গান-বাজনা নিয়েই সময় কাটতো আমাদের, কথা হত গান নিয়েই। আমাদের জীবনটাই ছিল একেবারে অন্যরকম যা ভাষায় অপ্রকাশযোগ্য।
– আর, বন্ধুত্বের বাইরে তিনি কেমন শিল্পী ছিলেন বলে আপনি মনে করেন ?
– রিয়েলি একজন শিল্পী ছিলো বটে, একদম, কোনরকম অহংকার নেই, এক অসাধারণ শিল্পী ছিলো অসাধারণ! এবং সুবীর নন্দীর লস (ক্ষতি) দেশ আস্তে আস্তে কিছু বুঝতে পারবে কত বড় একজন শিল্পীকে হারিয়েছি! কারণ সুবীর নন্দীর মতো গান কেউ আর গাইতে পারবে না, যে যত চেষ্টাই করুক। একজন জাতশিল্পী ছিল, জাতশিল্পী।
– অবশেষে নন্দী ভক্তদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন যারা দেশে ও দেশের বাইরে আছেন –
– আমি তো নিজেই ভক্ত ওর এবং ওর গানের। দেশে এবং দেশের বাইরে যেসব সুবীর নন্দীর ভক্ত আছে তাদের জন্য একটা আফসোসের কথাই আমার বলতে হবে যে সুবীর নন্দীর মত গান কিন্তু কেউ গাইতে পারবে না আর এবং আমাদের সুবীর নন্দী যে সব গান গেয়ে গেছেন সেই গানগুলি আমাদের শুনতে হবে এবং গানগুলির মাধ্যমেই সুবীর নন্দী আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
– সঙ্গীতাঙ্গনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, আপনার জন্য শুভ কামনা।
– তোমরাও ভালো থাকো, তোমাকেও ধন্যবাদ। সঙ্গীতাঙ্গন এর জন্য শুভকামনা, শুভকামনা নন্দী ভক্তদের জন্য, শুভকামনা বিশ্ববাসীর জন্য।
অবশেষে সুবীর নন্দীর গান দিয়েই তাঁর প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি –
কত যে তোমাকে বেসেছি ভালোসে কথা তুমি যদি জানতে
এই হৃদয় চিঁড়ে যদি দেখানো যেতো
আমি যে তোমার তুমি মানতে।
ওই দু’টি চোখ যেন জলে ফোটা পদ্ম
যত দেখি তৃষ্ণা মেটে না,
ভীরু দু’টি বাঁকা ঠোঁটে পূর্ণিমা চাঁদ ওঠে
হাসলেই ঝড়ে পরে জোছনা।
আমি এই রূপ দেখে দেখে মরতে পারি
তেমনি পারি ওগো বাঁচতে
সে কথা তুমি যদি জানতে।
ওই কালো কেশ তুমি ছড়ালে যখন
মেঘেরাও পেলো জেনো লজ্জা,
আকাশের তারা গুলো বাসর সাজিয়ে দিলো
মধুময় হলো ফুলসজ্জা।
ওগো এই রাত যেন কভু শেষ না হয়
জীবন বেলার শেষ প্রান্তে
সে কথা তুমি যদি জানতে।…