– গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী।
সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান দৃশ্যমান জগতে নয় গ্রহ-নক্ষত্রের ওপারে চলে গেছেন। গভীরতম গোপন গুহায় চিরকালের জন্য আত্মগোপন করেছেন। সীমাহীন তারের বীণায় সুর তুলবেন। তাঁর আত্মা জ্যোর্তিমন্ডলে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবে বন্ধনহীন স্বাধীনতায়। জীবন মানে বিরতিহীন যাত্রা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। আজাদ ভাই তাঁর যাত্রার পরিসমাপ্তি করেছেন। এখন মহাশূন্যে অপার্থিব সুরের অনুসন্ধান করবেন। অনন্ত জীবনের গান গাইবেন। নৈঃশব্দের বেদিতে সুরের সৌন্দর্য পান করবেন।
আমি কাছে না গেলে কোনদিন বুঝতে পারতাম না আজাদ ভাই কি মহৎ অন্তরের অধিকারী, কি তার গভীর জীবন তৃষ্ণা। তিনি সঙ্গীত জীবনের লক্ষ্য গুলোকে কিভাবে পরিণত করেছেন সংগীতের ঝর্নায়। কিভাবে অবিরত তিনি সুরের তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত থেকে সংগীতের সুধা পান করেছেন। কিভাবে আত্মার ভেতর সুরের গোপনীয়তাকে অন্বেষণ করেছেন। কী অবিশ্বাস্য ভালোবাসায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও খেয়াল নিয়ে স্বপ্ন নির্মাণ করেছেন সে স্বপ্ন আজীবন ফেরিও করে গেছেন। তিনি একাধারে সুরকার গীতিকার শিল্পী ও সংগীত পরিচালক, বাংলা খেয়াল এর পথিকৃৎ।
জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো-এই একটি গানে প্রমাণ করেছেন তার ভিতরে সুরের কত বৃহত্তর সমুদ্র বিরাজমান। যে গান বাংলার মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে আত্মার গভীরতায় পৌছে গেছে। সুরের কি অসাধারণ অন্বেষণ বিজ্ঞতার কি উচ্চ মাত্রার পরিচয়। এই একটি গান আজাদ রহমানকে অভিনন্দন প্রশংসা খ্যাতির ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। একটি গান তাঁর সঙ্গীত জমিনকে প্লাবিত করে দিয়েছে। একটি গান তার জীবনের চারিপাশে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে।
লোভ মোহ অহমিকা জীবনের মৌলিক সত্তা থেকে আজাদ রহমানকে কোনদিন বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তিনি সকল ধরনের আচ্ছাদনের আড়ম্বর থেকে মুক্ত। তিনি সর্বদাই তার কর্মের মর্যাদায় উজ্জল। তিনি সংগীতের উদ্ভব গঠন ও ইতিহাস নিয়ে গভীরতর চর্চা করেছেন। আজাদ রহমান সংগীতের দায়বদ্ধতা সংগে নিয়েই অবিরাম পথ হেঁটেছেন। সংগীতের সেই পথটি তিনি অনুসরণ করেছেন যার শুরু আছে শেষ নাই।
সংগীত কেন্দ্রিক বহু অনুষ্ঠানে আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তিনি স্বল্পবাক কিন্তু অসাধারণ বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। প্রবলভাবে মনকে আলোড়িত করতেন অনুপ্রাণিত করতেন, সুরের শুদ্ধতা সম্পর্কে তীক্ষ্ণ ভাবে সচেতন করতেন, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস জোগাতেন। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা জীবন ও জগতের নানাবিধ সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুবই গভীর ও সচেতন। আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্য ও গন্তব্য নিয়ে ছিলেন আত্মমগ্ন। তিনি মানুষ হিসেবে তীব্র আত্মসচেতন, অতীব পরিমার্জিত ও প্রগাঢ় ছিলেন।
আজাদ রহমানের সুরে আমার অন্তত একটি গান করার গোপন ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিনের। তিনি সম্মতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার নিম্নমানের অহমিকা ও অদূরদর্শিতার কারণে আমার অন্তরাত্মার গোপনীয়তা আর কোনদিন পূর্ণ হবে না।
এখন আমার অনেক অনুশোচনা হচ্ছে। আজাদ রহমানের সুরে আমার একটা গান থাকলে তা আমার গানের আকাশে রংধনু হয়ে থাকতো। ভালোবাসার মূল্য কত, ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই, মনেরও রঙ্গে রাঙ্গাবো ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায় এমন অসংখ্য গানের অধিনায়ক আজাদ রহমান। তিনি সংগীতের উচ্চতম জায়গায় অবস্থান নিয়ে ছিলেন।
সারাজীবন ভ্রমণ করেছেন সংগীতের গভীরতায়। তিনি আমাদের অহংকার। কিন্তু সেই আজাদ রহমানকে চিরদিনের মত চিরকালের জন্য চির জনমের বিদায় দিতে যেতে পারলাম না করোনার সর্বগ্রাসী ভয়ে। এ কেমন বেঁচে থাকা এ কেমন দহনকাল। আমার পরম আপনজন চলে যাবেন চিরতরে আর আমি ঘরে বসে থাকবো এটা কোন জনমের পাপের প্রতিদান। এ বেঁচে থাকা লজ্জাজনক। এ কেমন অভিশপ্ত প্রকৃতি।
আজাদ ভাই সেলিনা আপা ক্ষমা করবেন জানাজায় যাইনি বলে। করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে জানাজায় না গেলে অনন্ত জীবনের অধিকারী হওয়া যায়। অমরত্ব লাভ করা যায়। এখন করোনা আমাদের গুরু আর আমরা তার ছাত্র।
আজাদ ভাই পরপারে দেখা হলে আবারও ক্ষমা চাইবো আর অভিযোগ করবো কেন করোনা কালে জীবন সমাপ্তির চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করলেন।
বিখ্যাত সাহিত্যিক কহলীল জিবরান এর একটি উক্তি দিয়ে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষ করছি। “ভালোবাসা কি বিশাল এবং আমি কত ক্ষুদ্র।”