– মোশারফ হোসেন মুন্না।
লাকী আখান্দ বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক। তিনি ব্যান্ড দল হ্যাপী টাচ এর সদস্য। তার সঙ্গীতায়জনে করা বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে এই নীল মনিহার, আবার এলো যে সন্ধ্যা এবং আমায় ডেকো না। তিনি বাংলাদেশী জাতীয় রেডিও নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ বেতার এর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। লাকী আখান্দ ১৯৫৬ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার পাতলা খান লেনে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৫ বছর বয়সেই তিনি তার বাবার কাছ থেকে সঙ্গীত বিষয়ে হাতেখড়ি নেন। তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার এবং ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালে লাকী আখান্দ তাঁর ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দের একটি এ্যালবামের সঙ্গীতায়োজন করেন। এ্যালবামটিতে “আবার এলো যে সন্ধ্যা” ও “কে বাঁশি বাজায়রে” গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী আখন্দ, “স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে” ও “পাহাড়ি ঝর্ণা” গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী ও লাকী দুজনে, এবং লাকী নিজে “নীল নীল শাড়ি পরে” ও “হঠাৎ করে বাংলাদেশ” গানে কণ্ঠ দেন। আখান্দ ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই চলচ্চিত্রে হ্যাপী আখন্দের পূর্বের এ্যালবামের “আবার এলো যে সন্ধ্যা” গানটি ব্যবহৃত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৮৪ সালে তিনি তাঁর প্রথম একক এ্যালবাম লাকী আখান্দ প্রকাশ করেন। এ্যালবামটি সারগামের ব্যানারে প্রকাশিত হয়। এই এ্যালবামের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান হল “আগে যদি জানতাম”, “আমায় ডেকোনা”, “মামুনিয়া”, “এই নীল মনিহার”, ও “হৃদয় আমার”। লাকী আখান্দের সঙ্গীতচর্চা বন্ধ হয় তাঁর ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দ ১৯৮৭ সালে মারা যাওয়ার পর। তিনি প্রায় এক যুগ পরে ১৯৯৮ সালে পরিচয় কবে হবে ও বিতৃষ্ণা জীবনে আমার এ্যালবামের সঙ্গীতায়োজনের মাধ্যমে গানের ভুবনে ফিরে আসেন। পরিচয় কবে হবে ছিল তাঁর দ্বিতীয় একক এ্যালবাম এবং হ্যাপী আখন্দের একক এ্যালবাম শেষ উপহার-এর রিমেক। বিতৃষ্ণা জীবনে আমার ছিল ব্যান্ড ও আধুনিক গানের মিশ্র এ্যালবাম। এতে সে সময়ের ছয়জন জনপ্রিয় গায়ক – মাহফুজ আনাম জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, ও সামিনা চৌধুরী কণ্ঠ দেন। একই বছর তিনি সামিনা চৌধুরীকে নিয়ে আনন্দ চোখ নামে একটি দ্বৈত এ্যালবাম প্রকাশ করেন। গোলাম মোরশেদের সঙ্গীতে এবং লাকী আখান্দের সঙ্গীতায়োজনে এ্যালবামটি প্রকাশ করে সাউন্ডটেক। এতে ১২টি গান ছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান ছিল “কাল কি যে দিন ছিল”, “বলো কে পারে” ও “এই বর্ষা রাতে”। পরের বছর আখান্দ সামিনা চৌধুরীর একক এ্যালবাম আমায় ডেকোনার সঙ্গীতায়োজন করেন। এছাড়া তিনি ব্যান্ডদল আর্কের “হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা” গানের সুর করেন। ২০০০ সালের পর তিনি আরেকটি মিশ্র এ্যালবাম তোমার অরণ্যের সুর ও সঙ্গীতায়োজন করে। এতে লাকী আখান্দের কণ্ঠে গাওয়া ৩টি গানসহ বাপ্পা মজুমদার, ফাহমিদা নবী, ও নিপুর কণ্ঠে ১০টি গান ছিল। তিনি এই এ্যালবামে সমকালীন তাল, লোক গানের তাল ও তার প্রিয় স্পেনীয় গানের তাল ব্যবহার করেন। ১৯৬৯ সালে লাকী আখান্দ পাকিস্তানী আর্ট কাউন্সিল হতে “বাংলা আধুনিক গান” বিভাগে পদক লাভ করেন। কিন্তু এত সফলতা যে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নেবে কে জানতো? হয়তো লাকী আখান্দ নিজেই জানতেন না যে পরপারের ভিসা তার হাতে এসে গেছে।
লাকী আখন্দ দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি নিজের আর্মানিটোলার বাসাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্মরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সঙ্গীত জগত গভীর শোক প্রকাশ করেন। সঙ্গীতের সুরে যেন মরিচা ধরে যায়। সবার মনে একটাই কথা লাকী ভাই নাই, আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তার চলে যাওয়ার দিনটি সঙ্গীত ভূবনের জন্য না ভূলার মত একটি অধ্যায়। গুণী এই মানুষটি চলে যাবার পর কি ভাবে যে একটি বছর কেটে গেলো। আজ তার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। সঙ্গীতাঙ্গন এর সর্বস্তরের মানুষ তার স্মৃতিচারণা করে করছেন বিভিন্ন গান অনুষ্ঠান ও আলোচনা।
“তুমি মরে গিয়েও আছো বেচেঁ
সুরের ভূবনে,
কারণ তুমি সুরকে নিয়েছিলে
আপন করে জীবনে।
তোমার মৃত্যুতে ভূলেনি তোমায়
সঙ্গীতের কোন লোক,
তোমায় ছাড়া শুন্য সবার
সঙ্গীত পিপাসীত বুক।
মৃত্যুর দোয়ারে তুমি দাড়িয়ে সেদিন
হাতে নিয়েছিলে গিটার,
এখনো তো ভূলিনি কেউ সে স্মৃতি
মনে পরে যায় সেই স্মৃতিটা।
উপারেতে থেকো সুখে এই যে প্রার্থনা
শুধু তোমার জন্য।