– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
একধারে জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী শ্রদ্ধেয় আজাদ রহমান গুরুতর অসুস্থ হয়ে গত ২১ মার্চ গ্রীনরোডে অবস্থিত ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। করোনা ভাইরাসের কারণে অনেকেই অনেক কথা বলছেন বা বলবেন কারণ আজকাল কেউ অসুস্থ হলেই আগেই করোনা ভাইরাসের ভীতিটা সবার মধ্যে ফুটে উঠে। তাই তো ডাক্তাররাও সাধারণ সর্দি কাশিকেও অবহেলা করে, করোনার ভয়ে রোগী দেখা বন্ধ করে দেয়। তবে জনপ্রিয় এই কিংবদন্তীর অসুস্থতার প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত পুরো ইতিহাস জানতে পারলে, হয়তো ভুল ভাঙ্গবে সবার। তাই তাঁর একজন প্রিয় ছাত্রী, তিনি বাংলাদেশ রেডিও, টিভিতে এনলিস্টেড কণ্ঠশিল্পী শাহিনা আক্তার পাপিয়া। তাঁর কাছে শরণাপন্ন হলাম, শ্রদ্ধেয় আজাদ রহমানের শারীরিক অবস্থা জানার জন্য। কারণ সে প্রতিদিনই শ্রদ্ধেয় আজাদ রহমানকে দেখতে যান, করোনা ভাইরাসের মত এই দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশকে উপেক্ষা করে। একেই বলে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রীর ভক্তি, শ্রদ্ধা। শাহিনা আক্তার পাপিয়ার কাছ থেকেই জানা গেল, আজাদ রহমানের শারীরিক অবস্থার আগের এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে তাঁর কোলনস্কপি করা হয়, তাতে সিষ্ট ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে গত ২৩ মার্চ তাঁর অপারেশন করা হয়। তিন ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। বায়োপসি রিপোর্ট খারাপ না, তবে অপারেশনের পরবর্তী সময়ে তাঁর শরীরে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, যেমন শ্বাসকষ্ট, বুকে সমস্যা, খিঁচুনি। এরই মধ্যে তিনদিন আগে তাঁর ছোট্ট একটা হার্ট এ্যাটাক হয়। তার ফলে তাঁকে সিসিইউ-তে রাখা হয়। সেখানে ছত্রিশ ঘন্টা থাকার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে তাঁকে কেবিনে
নিয়ে আসা হয় কিন্তু আজ দুপুরে (২ এপ্রিল) দ্বিতীয়বারের মত হার্ট এ্যাটাক হলে এবং ফুসফুসেও সমস্যা দেখা দিলে দুপুর তিনটায় তাঁকে আবার সিসিইউতে নেয়া হয়েছে। শাহিনা আক্তার পাপিয়া বলেন, তিনি মানসিকভাবে ভীষণ স্ট্রং! কারণ শাহিনা আক্তার পাপিয়া যখন তাকে সিসিইউ-তে দেখতে যান, তখন তার কাছে জানতে চাওয়া হলে যে, তিনি ভালো আছেন কিনা! তখন তিনি তাকে মাথা নেড়ে উত্তর দেন যে, ভালো আছেন। তাঁর সেন্স পুরোপুরি কাজ করছে। সেই সাথে তিনি সকলের কাছে তাঁর জন্য দোয়া চাইতে বলেছেন। হাসপাতালে কে কে আছেন তাঁর সাথে জানতে চাইলে পাপিয়া বলেন, তাঁর স্ত্রী সঙ্গীত শিল্পী সেলিনা আজাদ আছেন এবং তাঁর বোন ও ফুফাত বোন আছেন সাথে। তাঁর তিন মেয়ে। তাঁরা বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, তাই আসতে পারছেন না।
সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান একধারে একজন গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী। পাশাপাশি তাঁকে খেয়াল গানের জনকও বলা হয়। শ্রদ্ধেয় আজাদ রহমান ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভারতের রবীন্দ্র ভারতী কলেজ থেকে খেয়ালে অনার্স সম্পন্ন করেন। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন তিনি ফোক, কীর্তন, ধ্রুপদীসঙ্গীত, খেয়াল, টপ্পা গান, ঠুমড়ি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, অতুল প্রসাদের গান, দিজেন্দ্র গীতি, রজনীকান্তের গান চর্চা করেন। একই সময় তিনি ক্রিশ্চিয়ান এক পুরোহিতের কাছ থেকে পিয়ানো বাজানো শেখেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতার ‘মিস প্রিয়ংবদা’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালকের মধ্য দিয়ে তিনি চলচ্চিত্রের গানে আগমন করেন। এই ছবিতে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় গান গেয়েছিলেন – মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আরতি মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশে তিনি প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন পরিচালক বাবুল চৌধুরীর ‘আগুন্তক’ ছবিতে। তাঁর সুরারোপিত ও তাঁর নিজের কণ্ঠে গাওয়া ‘এপার ওপার’ চলচ্চিত্রের ‘ভালবাসার মূল্য কত’, ডুমুরের ফুল চলচ্চিত্রের ‘করো মনে ভক্তি মায়ে’, দস্যু বনহুর চলচ্চিত্রের ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’ গানগুলো সত্তরের দশকে ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি ‘বাদী থেকে বেগম’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘আমার সংসার’, ‘মায়ার সংসার’, ‘মাসুদ রানা’ -র মত অসংখ্য ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, গান লিখেছেন এবং সুরারোপিত করেছেন। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ -এর মত কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানের সুর করেছেন। জনপ্রিয় কিংবদন্তী আজাদ রহমান ‘যাদুর বাঁশী’ এবং ‘চাদাবাজ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এবং ‘চাদাবাজ’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তাছাড়া সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান।
সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে এই জনপ্রিয় কিংবদন্তী শিল্পীর সুস্থ্যতা কামনা করছি এবং মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন, সেই দোয়া করছি। সেই সাথে সঙ্গীতাঙ্গন-কে শ্রদ্ধেয় আজাদ রহমানের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে সহযোগিতার করার জন্য সঙ্গীত শিল্পী শাহিনা আক্তার পাপিয়ার জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা।