– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
এবারই প্রথম বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বাঙ্গালীর পহেলা ফাল্গুন একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। শুধু এ বছরই নয়! এখন থেকে প্রতিবছর, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পহেলা ফাল্গুন পালিত হবে একই দিনে। জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে মন্ত্রীসভায় ২০২০ সালের সরকারি ছুটির তালিকা অনুমোদিত হয়। সেখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে তালিকা প্রকাশ করে, তাতে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মত ঐতিহাসিক দিবসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পঞ্জিকার পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেই অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকাবর্ষে বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাস হবে ৩১ দিনে। কার্তিক থেকে মাঘ মাস হবে ৩০দিনে এবং ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের। কিন্তু গ্রেগরির পঞ্জিকার হিসেবে ২০২০ সালের ফাল্গুন হবে ৩০ দিনের। তাই সেই হিসেবে পহেলা বৈশাখ আগের মত ১৪ এপ্রিল থাকলেও এই বছর একদিন পিছিয়েছে পহেলা ফাল্গুন। পরিবর্তিত পঞ্জিকার দিন তারিখ অনুযায়ী বৈশাখ মাসের সাথে একদিন যোগ হয়ে ৩১ দিন হয়েছে। তার ফলে পহেলা ফাল্গুন পিছিয়েছে একদিন। তাই সংশোধিত পঞ্জিকা অনুযায়ী এখন থেকে প্রতিবছর, ১৪ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস একই সাথে পালন করা হবে।
এবার আসা যাক বিশ্ব ভালোবাসা দিবসটি কেন পালন করা হয় সেই প্রসঙ্গে। কথিত আছে ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স নামে একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তৎকালীন
রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এই জন্য সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের
জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। আর তাই তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে সম্রাট তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউ ও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন’স স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন’স দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকে সকলের জন্য এইদিনটিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
এই ভালোবাসা দিবসকে সকলের কাছে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, হাই কমিশন অফ ইন্ডিয়া, ঢাকা ‘কথা ও সুরে ভালোবাসার গান’- নামে জাতীয় জাদুঘরে বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠানে গান করেন দুজন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী, তাঁরা হলেন রাশেদুল আলম প্রদীপ এবং বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি। অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে শ্রদ্ধেয় শিল্পীদের কিছুটা পরিচয় দেয়া দরকার বলে মনে করছি !
শিল্পী রাশেদুল আলম প্রদীপ- তিনি সুরবানী ললিতকলা একাডেমী এবং বুলবুল ললিতকলা একাডেমী (বাফা) থেকে নজরুল সঙ্গীতের ওপর শিক্ষালাভ করেন। তাছাড়া তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত, ফোক এবং ক্লাসিকেল মিউজিকের ওপর তালিম নেন সাধন চন্দ্র বর্মণ, পঙ্কজ দেবনাথ ও সাহাদেব ঘোষ এর কাছ থেকে। সে এই সকল গান ছাড়াও সে সিঙ্ঘালী, চাকমা ও কোরিয়ান গানেও পারদর্শী। সে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর একজন সদস্য এবং একুশে থিয়েটার ও নোঙর কালচারাল ফোরামের পৃষ্ঠপোষক। সঙ্গীতের পাশাপাশি সে একজন ফটোগ্রাফার ও ফিল্ম মেকার। অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তার মধ্যে ১৯৯৫-৯৯ শিশু বিভাগে জাতীয় পুরুস্কার উল্লেখযোগ্য। তিনি জাতীয় জাদুঘরে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।
বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি- তিনি ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকে নজরুল সঙ্গীতের ওপর শিক্ষালাভ করেন। সেই সাথে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত, ফোক ও ক্লাসিকেল মিউজিকের ওপর তালিম নেন। উস্তাদ মাশকুর আলী খান, শ্রী স্রিরু কালা
কারকার, সুলুপানা জুপিটার এবং পণ্ডিত সারথি চ্যাটার্জী ছিল তাঁর সঙ্গীতের গুরু। সে বাংলাদেশ নজরুল সঙ্গীত পরিষদের একজন সদস্য এবং রেগুলার আর্টিস্ট বাংলাদেশ টেলিভিশন সহ বিভিন্ন চ্যানেলে। সে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে কাজ করেছে ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’ টেলিফিল্মে। তাছাড়া তিনি সঙ্গীতের পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকুরী করছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি (BUET)ইন আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে ২০০৮ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত।
অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে আসি। সেদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি একেই তো ছিল শুক্রবার! একই সাথে ছিল পহেলা ফাল্গুন আর ভ্যালেন্টাইন’স ডে এর উৎসব। তার সাথে বইমেলা তো আছেই। রাস্তায় মানুষ আর গাড়ির ভীরে এগোনো যাচ্ছিলনা! সেই কারণে সেদিন অনুষ্ঠান যখন হওয়ার কথা ছিল, তার এক ঘন্টা পরে শুরু হয়েছিল। তারপরেও অনুষ্ঠানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছিল। একটি অসাধারণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলেন ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারের ডিরেক্টর ডঃ নিপা চৌধুরী। বিশিষ্ট শিল্পী রাশেদুল আলম প্রদীপ ও বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি- দুজনে মিলে নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ফোক গান করেছেন, সেইসাথে শচীন দেব বর্মণ, মান্না দে, আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী প্রমুখের ভালোবাসার গান গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন ভালোবাসার মুগ্ধতায় ভরিয়ে তুলেন।
ভালোবাসার দিনে এই অনুষ্ঠানে এসে ভালোবাসার গান করে শিল্পীদের কেমন লেগেছে এবং তাঁরা কিভাবে তাঁদের গানগুলো নির্বাচন করেছেন, সেই বিষয়ে সঙ্গীতাঙ্গন থেকে জানতে চাওয়া হলে বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি বলেন, জীবন আসলে সফলতা আর ব্যর্থতা দুটো মিলেই। সেরকম ভালোবাসাও দু’ধরনের আছে! সেই কারণে সবার কথা চিন্তা করেই গানগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। পুরনো কিছু স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই এই গান। এই অনুষ্ঠানে এসে এত দর্শক শ্রোতাকে পেয়ে খুব ভালো লেগেছে। রাশেদুল আলম প্রদীপ বলেন, আমার খুব ভালো লেগেছে, এই অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে। আজকে এত ভিড়ের মধ্যেও এতজন গান শুনার জন্য উপস্থিত হয়েছেন, খুবই ভালো লেগেছে। সবাই ধৈর্য্য ধরে বসে আমাদের গান শুনেছেন এবং উৎসাহ দিয়েছেন, এটাই আমাদের অনেক পাওয়া! সবাই ভালো গান শুনুন এবং যারা সত্যিকারের শিল্পী তাঁদের উৎসাহিত করুন, এটাই আমাদের চাওয়া। আমাদের বাংলা গানকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই সবার ভালোবাসা ও আশীর্বাদের প্রয়োজন। তানাহলে তো আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবোনা।
সঙ্গীতাঙ্গনও এই কামনা করে, এরকম আরও বেশি বেশি অনুষ্ঠান হোক এবং আপনারাও গান গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন ভরিয়ে তুলুন, গানে গানে। শুভকামনা রইল আপনাদের সকলের জন্য সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে।
অনুষ্ঠানের ফেসবুক ভিডিও লিংক নীচে দেয়া হলো। –