কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পীর হাতে লেখকের কলম কথাটি পড়ে অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে, পপগুরুর সম্মানে কে এই শিল্পী ? যে গান-টান ছেড়ে কলম হাতে নিয়েছেন! অবাক হবারই কথা। কেননা একজন ব্যান্ড শিল্পী, যে কিনা সব সময় আচ্ছন্ন থাকেন সুরের মূর্ছনায়, সুরের ভুবনে, সে কি করে সাহিত্যের মত গুরুগম্ভীর ভুবনে এসেছেন। আসল ঘটনা হল, সে গানটান কিছুই ছাড়েননি। যেই ব্যক্তিকে নিয়ে এত কথা লিখেছি, সে হলেন জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতশিল্পী মাকসুদুল হক। অনেকে হয়তো জানেন না, আবার অনেকেই হয়ত জানেন! তিনি ‘ম্যাক’ নামেও পরিচিত। সঙ্গীত জগতে চার দশকেরও বেশী সময় ধরে তাঁর পথচলা। প্রথম প্রথম তিনি ইংরেজি গান বেশী গাইতেন। বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন গান গাইতেন যেমন- পপ, রক, রেগে ইত্যাদি। পরবর্তীতে তিনি বাংলা গান শুরু করেন। ফিডব্যাকে থাকাকালীন অ্যালবাম ‘উল্লাস’ প্রকাশের পর ব্যান্ড এবং তাঁর জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। এরপর ‘মেলা’ অ্যালবাম যখন প্রকাশ হয় তখন ‘মেলা যাইরে’ গানটি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরের বাংলাভাষীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। মেলা যাইরে গানটি ব্লকবাস্টার হিট হয়। তাছাড়া ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামটি যা বাংলা গানের স্টুডিও অ্যালবামের মধ্যে বছরের সেরা নির্বাচিত হয়, একটি বাংলা সাপ্তাহিকের পাঠক জড়িপে। ফিডব্যাক ছেড়ে মাকসুদ ১৯৯৬ সালে নিজের ব্যান্ড ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার মধ্যে মেলায় যাইরে, মৌসুমী, মাঝি, তোমার চিঠি উল্লেখযোগ্য।
এবার আসি এই ব্যান্ড শিল্পীর লেখালেখির প্রসঙ্গে। ১৯৯৯ সালের কিছু টুকরো লেখা নিয়ে ২০০৪ সালে ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন তিনি। বইটির জনপ্রিয়তা ও কাটতি থাকা সত্ত্বেও বইটি কোথাও পাওয়া যায়না তখন। তাই কিছুদিন আগে সে ঐ বইটি ই-বুক হিসেবে বের করেছেন। এছাড়া আরও দুটি বই লিখেছেন তিনি, একটি বাউলদের ওপর ভিত্তি করে আরেকটি ইংরেজি কবিতা। তবে ২০২০ সালের বই মেলায় তিনি যে বইটি প্রকাশ করেছেন, সেই বইটি বাংলাদেশের কিংবদন্তি পপগুরু আজম খানের সম্মানে এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই প্রকাশ করেছেন। এই বইটিতে আজম খানের সাথে তাঁর যে ঘনিষ্ঠতা ছিল সেই স্মৃতিচারণ করেছেন। মৃত্যু পথযাত্রী আজম খানের ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্য, ক্যানসারের তীব্রতা ও শেষ দিনগুলোতে বাঁচার তাগিদে তাঁর সংগ্রাম নিয়ে ধারাবাহিক মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলো তিনি সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি মনে করেন তবু মৃতপ্রায় আজম খান ছিলেন দৃঢ়চেতা, অত্যন্ত সাহসী এবং বাংলাদেশের সম্পদ। যার কোনো তুলনা হতে পারেনা। তাই তিনি মনে করেন, আজম খানের জীবনতো এত সহজে অগ্রন্থিত থেকে যেতে পারেনা। অন্তত তাঁর মত কেউ যতদিন বেঁচে আছে ততদিন তো নয়-ই। তাই তিনি তাঁর সাথে পপগুরু আজম খানের স্মৃতিগুলো ভুলতে না পেরে, স্মৃতিগুলো বই আকারে ধরে রাখার জন্য আবারও কলম হাতে নিলেন। মাকসুদুল হক এই বইতে তাঁর সাথে পপগুরু আজম খানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজম খানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। এই বইটি পড়লে পাঠকবৃন্দ জানতে পারবেন-একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাকে, একজন ক্যানসারের সাথে যুদ্ধরত যোদ্ধাকে এবং একজন কিংবদন্তি রকস্টার পপগুরু আজম খানকে।
মাকসুদুল হক মনে করেন- ‘রক’ বাংলাদেশের একটি বিপ্লবী সঙ্গীত ধারা এবং এই বইটি তাঁদের জন্য যারা এ ধারাকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে বিবেচনা করেন, চিন্তা চেতনা, বাক ও কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে আমরা যে যা হতে চাই তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস রাখেন, সেই ‘স্বাধীনতা’ যার জন্য আজম খান তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মাকসুদুল হক প্রথমে বইটি ইংরেজিতে লিখেছিলেন, বইটির নাম ছিল- “History of Bangladesh Rock: The Legacy Of Azom Khan” এটি বাংলায় অনুবাদ হয়ে “বাংলাদেশের রকগাথাঃ আজম খানের উত্তরাধিকার” নামে প্রকাশ হয়েছে বই মেলায়। বইটি অনুবাদ করেছেন কবি ও অনুবাদক ডঃ তানভীর হোসেন। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন- ইমতিয়াজ আলম বেগের ফটোগ্রাফার নিয়ে রাজীব দত্ত। বই মেলায় ‘চন্দ্রবিন্দু’ প্রকাশনের (বুকিশ পাব্লিকেশনের পরিবেশক) স্টলে পাওয়া যাবে বইটি।
সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাই জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতশিল্পী ও এই বইয়ের লেখক মাকসুদুল হক’কে। বইটি পাঠক সমাদৃত হবে এই কামনা করি।