– মাসরিফ হক।
আমাদের মানুষের জীবনের পথচলা শুরু হয় স্কুল/কলেজের মাধ্যমে এবং সেখানে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা, নাচ, গান, অভিনয় বিভিন্ন বিষয়ে হাতেখড়ি হয়। আমাদের আজকের সঙ্গীতপ্রেমী সোনিয়া সুলতানা-র জীবনের পথচলা ঠিক সেভাবেই শুরু হয়েছে ঢাকার পার্শ্ববর্তী শহর কুমিল্লাতে। তিনি বলেন, স্কুল/কলেজের বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতেন। খুব ভাল লাগতো গান করতে তবে পারিবারিকভাবে সহযোগিতা না পাওয়ায় কোনো গানের স্কুল বা ওস্তাদের কাছে তালিম নেয়ার সুযোগ হয়ে উঠে নাই। গান ছাড়া জীবন চলে, পড়ালেখা ছাড়া ঘোরাফেরা ও দৈনন্দিন কাজের মাঝে গুন গুন করে না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম হবে বলে আমাদের পাঠিকা বিশ্বাস করেন। তবে এই গুণগুণ করাটা তিনি মনে করেন একটি বয়স পর্যন্ত হতে পারে, তবে বুড়ো হয়ে গেলে কি হবে ? কে জানে ? এ ব্যাপারে সঙ্গীতজ্ঞ ছাড়াও অনেক বয়স্ককেও গুনগুন করতে দেখেছেন তিনি। তিনি মনে করেন, সঙ্গীত প্রেমীকরা জীবদ্দশায় গুন গুন করবেই।কোন্ কোন্ ধরনের গানের সাথে পরিচয় বা ভালোলাগা বা কি কি ধরনের গান পছন্দ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর আগে আধুনিক বা ব্যান্ড গানের সময় ছিল। স্বাভাবিকভাবে পপুলার গানগুলোই মনে গেঁথে থাকতো। তবে ছোট বয়সে দেশের গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীতই বেশী শোনা হতো। তখন দেশের গান বা রবীন্দ্র সঙ্গীতের দিকেই একটু বেশী জোঁক ছিল। দেশের গানও খুব ভাল লাগতো সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, আব্দুল আলীম, মাহমুদুন নবী, আব্দুল জব্বার, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সুবীর নন্দী, রফিকুল ইসলাম, আবিদা সুলাতান সহ আরও অনেক অনেক শিল্পীদের গান আমি খুব পছন্দ করি একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে।
দেশাত্নকবোধক গান ছাড়া আর কোন্ কোন্ ধরনের গান শুনতে পছন্দ করেন ?
তিনি বলেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত।
রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ, নজরুল সঙ্গীত পছন্দ নয় কেন ?
পছন্দ নয় কিন্তু বলিনি বা একজন এপারের বা আরেকজন ওপারের তাও বলিনি ? তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত কেমন যেন বিভিন্ন সময়ে শুনতে বা গাইতে ভাল লাগে আর নজরুল সঙ্গীত শুনতে মনে যেন সব সময় খুব মনযোগী হয়ে শুনতে হবে। তবে এইটা আমার জানার স্বল্পতার কারনেও হতে পারে। মোট কথা রবীন্দ্রসঙ্গীত গুন গুন করতে ভাল লাগে।
পছন্দের বা ভালবাসার কয়েকজন শিল্পীর নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন –
রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীদের নাম – রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, পাপিয়া সারোয়ার, কাদেরী কিবরিয়া, তপন মাহমুদ, মিতা হক, কামাল আহমেদ, নজিবুল হক, অদিতি মহসিন, দেবলীনা সুর, প্রিয়াঙ্কা গোপ…।
নজরুল সঙ্গীত শিল্পীদের নাম – ফিরোজা বেগম, সোহরাব হোসেন, ফেরদৌসী রহমান, খালিদ হোসেন, নীলুফার ইয়াসমিন, নাশিদ কামাল, ফাতেমা তুজ জোহরা, সাদিয়া আফরিন মল্লিক, ফেরদৌস আরা, রওশন আরা মোস্তাফিজ, খায়রুল আনাম সাকিল, প্রিয়াঙ্কা গোপ…।
আপনার তারুণের সময়ে আধুনিক গানের যে জোয়ারে ভেসেছিলেন সে সময়ে আপনার পছন্দের শিল্পী বা কোন্ কোন্ গানগুলো এখনও ভাল লাগায় ?
সে সময়ে শিল্পীদের মধ্যে সবাই ছিলেন তারুণ্যে দীপ্ত। সেই হিসেবে প্রিয় আধুনিক সঙ্গীত শিল্পীদের নাম – রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, তিমির নন্দী, রফিকুল আলম, লাকী আখন্দ, আবিদা সুলতানা, শাকিলা জাফর, এন্ড্রো কিশোর, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলু, তপন চৌধুরী, বেবী নাজনীন, আঁখি আলমগীর, আগুন, শুভ্র দেব, ডলি সায়ন্তনী ও আরও অনেকে। গানের হিসাব দিয়ে শেষ করা যাবে না। কারণ আমরাতো গান কোথাও পরিবেশন করি না। ভালোলাগা বা ভালবাসার গান গুলো মন থেকেই গুণগুণ করে আবার বিভিন্ন পরিবেশে মনের ভিতর ব্যাকগ্রাউন্ডেও বাঁজে। কথাগুলো কি মিথ্যে বলছি খেয়াল করে দেখবেন। আমার মনে হয় গান হচ্ছে একটি পবিত্র বিষয়, যেমন কোরআন শরীফও সুর করে পড়া হয়। সেখানে সুরের মাধ্যমে জীবনের প্রয়োজনীয় কথা গুলো বলা হয়েছে ঠিক তেমনি আমাদের (সবার) ভাষায় গানের মাধ্যমেও তা তুলে ধরা হয়। সেই গানগুলোকে আমরা হামদ ও নাত বলে থাকি। তাহলে ভাবছেন অন্য সব গানকে কি বলবেন ? হামদ ও নাত গানে আল্লাহ্-র বানীর কথা বলা হয়েছে আর আমাদের গান সময় সময়ের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে এবং সেখানেও ঘুরে ফিরে মানব কল্যাণের কথাই বলা হয়ে থাকে। আমি বিজ্ঞ মানুষ না আমার কথা গুলো ভুলও হতে পারে তবে আমার কাছে আমি এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
আপনার প্রিয় ব্যান্ড – সব ব্যান্ডেরই কিছু কিছু গান ভাল লাগে তার মধ্যে সোলস, রেনেসাঁ, ফিডব্যাক, মাইলস, এল আর বি, জেমস, চাইম, অবসকিউর, নোভা, প্রমিথিউস, চিরকুট, জলের গান সহ আরও অনেক ব্যান্ড আছে।
এসময়ের শিল্পীদের গান কেমন লাগে ? এখনকার শিল্পীদের গান কি শোনা হয় বা দেখা হয় ?
এখন গানতো শুধু শোনার না দেখারও। জ্বি দেখছি ও শুনছি। এখনকার মধ্যে আসিফ আকবর, ন্যান্সি, হাবিব, ইমরান, কনা, কোনাল, বাপ্পা মজুমদার, পারভেজ, হৃদয়, প্রীতম, প্রতিক, রাফাত, আরমান আলীফ আরো অনেকে।
এ সময়ের একটি গুঞ্জন হচ্ছে ভাল মানের গান হচ্ছে না আপনি কি মনে করেন ?
(অনেক সময় নিয়ে চিন্তা করে) আমি সঙ্গীতজ্ঞ না সঙ্গীত প্রেমিক। আমাদের জন্যই শিল্পীরা গান উপহার দিয়ে থাকেন, সমালোচনা করা আমাদের মানায় না তবে এভাবে চিন্তা করা যায় কিনা একটু ভেবে দেখবেন – এ মুহূর্তে আমরা ভাল গান পাচ্ছিনা, কারা পাচ্ছে না ? তাদের বয়স কত ? যুগ যুগ পর একটি জেনারেশন পাল্টাচ্ছে। তাই যুগ যুগ পর গানের ধরনও পাল্টাচ্ছে। পিছনে ফিরে তাকালে কি আমরা তাই দেখতে পাই না ? প্রতি মুহূর্তে স্বাধেরও পরিবর্তন হচ্ছে, আমাদের সময় ব্যান্ড সঙ্গীতকে অপসংস্কৃতি বলতো কিন্তু এখন দেখুন সেই অপসংস্কৃতি ছাড়া আমাদের নববর্ষ থেকে বিয়েবাড়ি, নেতাদের বক্তৃতার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে কর্পোরেট অফিস আদালতে কোথাও এর চাহিদার কমতি নাই। তাই মনে হয় এসময়ের গান আমাদের বয়সের বা তাঁর চেয়ে বেশী বয়সের মানুষরা গ্রহন করতে পারছি না। একটা সময় যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাব আর আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের স্থানে থাকবে তখন হয়তবা এই সময়ের গানগুলো স্থান করে নেবে। তবে এসময়ে যেমন আমরা সময়ের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যা শ্রুতিমধুর গান শুনছি ঠিক তখনও এর প্রভাব চলতে থাকবে। নতুনরা চলতে থাকবে আর পুরনোরাও দাপটের সাথে জায়গা দখল করে থাকবেন। এবং তা দেখতে পাই পশ্চিমা জগতে যেখানে দেশের বয়স শত শত বছর পার হয়ে যাবার পরও এই জেনারেশনরা তা ধরে রাখছে ও ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার মাঝে। আমরাও সেইভাবেই চলবো। এভাবেই স্রোত বহমান থাকবে চিরকাল।
শুধুতো দেশের বাংলা গানের কথা বলা হলো যদি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের কথা বলি তাহলে তাঁর লিস্ট আরও বড় হয়ে যাবে।
পারিবারিকভাবে আপনার সংসারে কেউ কি সঙ্গীতের সাথে জড়িত আছে কি ?
– না এখনো সম্ভব হয় নি তবে আশা রাখছি আমার মেয়েকে গানে দেব, তাঁর কিছু শেখার সময় হয়েছে। আমার মেয়ের নাম অবনী, সে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। আমার আরও দুই ছেলে রাফায়েত ও রাফসান ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, বড় ছেলেটি ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষে পড়ছে আর ছোট ছেলে থার্ড সেমিস্টার দিয়েছে। দুই ছেলেই মিউজিক পাগল, প্রচুর গান শোনে, সব ধরনের গান শুনতে দেখে ভাল লাগে। ছোট ছেলে একটু বেহালার প্রতি আগ্রহ তাই কিছুদিন আগে জন্মদিনে তাঁর বন্ধুরা বেহালা উপহার দিয়েছে। সুতারাং তাঁর মিউজিক শেখার ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। পড়ার মাঝে সময় সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়, এব্যাপারে সঙ্গীতাঙ্গন সাহায্য করতে পারলে খুব খুশী হবো। সঙ্গীতাঙ্গন পত্রিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে আমার মতো একজন সাধারণ গৃহিণীর কথা জনসম্মুখে তুলে ধরার জন্য, আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। আমি যদি আমার কোন কথায় কাউকে আঘাত দিয়ে থাকি আমাকে ক্ষমা করবেন।
পাঠকের সঙ্গীত নিয়ে চিন্তাভাবনা বিভাগে এভাবেই আপনাদের সামনে হাজির হবো নতুন নতুন সঙ্গীতপ্রেমীদের নিয়ে এবং সঙ্গীতজ্ঞরা আপনারাও জেনে নিতে পারবেন শ্রোতাদের প্রিয় শিল্পী সম্পর্কে। সংস্কৃতির প্রধান বাহক সঙ্গীত। সব সময় সঙ্গীতাঙ্গন এর সাথে থাকুন।