মোশারফ হোসেন মুন্না।
এক যে ছিল সোনার কন্যা,
মেঘে বরন কেশ,
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ,
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া,
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছাঁয়া,
হাত খালি গলা খালি
কন্যার নাকে নাকফুল
সেই ফুল পানিতে ফেলে
কন্যা করছে ভুল
কন্যা ভুল করিস না
আমি ভুল করা কন্যার সাথে
কথা বলবো না।
জনপ্রিয় এই গানটি একসময় ছিল লোকের মুখে মুখে, এখনো আছে। মায়া ভরা কন্ঠে সুন্দর একটি সুরে গানটি গেয়েছেন সঙ্গীত জগতের এক অম্লান স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করা গায়ক সুবীর নন্দী। ছোট থেকে বৃদ্ধ এমন কেউ নাই যে কিনা সুবীর নন্দীর গান পছন্দ করে না। আর তাইতো গানের মাধ্যমে বেঁচে আছেন আর বেঁচে থাকবেন সঙ্গীতাঙ্গনের মণিকোঠায় শ্রদ্ধেয় সুবীর নন্দী। মানুষ স্রষ্টার অপার সৃষ্টি, যে পৃথিবীতে যেমনি নিয়ম মেনে আসে তেমনি নিয়ম মেনেই আবার চলে যান, এটাই তো নিয়ম। পৃথিবীতে যখন কোন মানুষ আগমন করেন তখন সবাই খুশি হন আনন্দ উপভোগ করেন। তাকে নিয়ে আনন্দ উল্লাস করেন, কিন্তু একটা সময় আসে যখন সেই মানুষটাই আস্তে আস্তে আমাদের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তার রেখে যাওয়া কর্ম আমাদের মনকে এতটাই প্রশান্তি এনে দেয় সে চলে যাওয়ার পর তার অভাব অনুভব করতে পারি। পৃথিবী থেকে বিদায় হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আমরা বছরে দুবার-ই মনে করি এক হচ্ছে তার জন্মদিন আর দুই হচ্ছে তার মৃত্যুর দিন। এই দুই দিনে আমরা তাকে বেশি মনে করি তবে হ্যাঁ তাদের মধ্যেই কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কর্ম দিয়ে প্রতিদিনই প্রতিনিয়ত তাকে আমরা মনে করতে হয়, মনে করতে বাধ্য। আর তাদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দী। আজকের এই দিনে হয়তো ছোট্ট শিশু সুবীর নন্দী যখন তার মায়ের কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আগমন করেছেন সেই দিন তার পরিবারসহ আশেপাশে প্রতিবেশীরা হয়তো খুবই খুশি হয়েছেন কিন্তু আজকে ওই দিনটি কিন্তু, কেউ খুশি হতে পারছেন না, কারণ আজ তিনি বেঁচে নেই আমাদের মাঝে। চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর যদি আমরা সুবীর নন্দীর জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কেটে আনন্দ সহকারে তার জন্মদিন পালন করতে চাই, সেখানে মোমবাতি নেভানোর মত মানুষ নেই। তাই
যদিও আজ তার জন্মদিন, শোকের সাথেই পালন করতে হচ্ছে।
সুবীর নন্দীর ডাক নাম বাচ্চু। সুবীর নন্দী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দী পাড়া নামক মহল্লায় এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত সঙ্গীত পরিবারে ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার নানা বাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাদেআলিশা গ্রামে। তার পিতা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সঙ্গীতপ্রেমী। তার মা পুতুল রানীও গান গাইতেন কিন্তু রেডিও বা পেশদারিত্বে আসেননি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভাই-বোনদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। তবে সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশবকাল চা বাগানেই কেটেছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাগানেই ছিলেন। চা বাগানে খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি বিদ্যালয় ছিল, সেখানেই পড়াশোনা করেন। তবে পড়াশোনার অধিকাংশ সময়ই তার কেটেছে হবিগঞ্জ শহরে। হবিগঞ্জ শহরে তাদের একটি বাড়ি ছিল, সেখানে ছিলেন। পড়েছেন হবিগঞ্জ গভঃ হাইস্কুলে। তারপর হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুবীর নন্দী দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। ১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই তিনি গান করতেন। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানে ছিলেন বিদিত লাল দাশ। সুবীর নন্দী গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিং এর মধ্য দিয়ে। প্রথম গান ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ -এর গীত রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম। ৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত সূর্যগ্রহণ চলচ্চিত্রে। ১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত অশিক্ষিত চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের ঠোঁটে তার গাওয়া ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮১ সালে
তার একক এ্যালবাম সুবীর নন্দীর গান ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। তিনি গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকরি করেছেন। এছাড়া তার প্রেম বলে কিছু নেই, ভালোবাসা কখনো মরে না, সুরের ভুবনে, গানের সুরে আমায় পাবে প্রকাশিত হয় এবং প্রণামাঞ্জলী নামে একটি ভক্তিমূলক গানের এ্যালবাম ও প্রকাশিত হয়।
চলচ্চিত্রে নন্দীর গাওয়া উল্লেখযোগ্য গান হল- দিন যায় কথা থাকে, আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি, হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, তুমি এমনই জাল পেতেছ, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো, পাহাড়ের কান্না দেখে, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়, একটা ছিল সোনার কইন্যা, ও আমার উড়াল পঙ্খীরে। তার প্রকাশিত প্রথম গানের এ্যালবাম সুবীর নন্দীর গান। এছাড়া তার অন্যান্য এ্যালবামগুলো হল প্রেম বলে কিছু নেই, ভালোবাসা কখনো মরে না, সুরের ভুবনে, গানের সুরে আমায় পাবে প্রকাশিত হয় এবং ভক্তিমূলক প্রণামাঞ্জলী। এই সব গানের মাধ্যমেই আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবেন শিল্পী সুবীর নন্দী।