মোশারফ হোসেন মুন্না।
জীবনরে জীবন ছাড়িয়া না যাও মোরে,
তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে
আদর করবে কে আমারে।
গানের কথায় ফুটে উঠেছে জীবনের কথা। যে জীবন নিয়ে এত মাতামাতি যে জীবনের জন্য পৃথিবীতে এত কিছু সেই জীবন যদি আমাদের কাছ থেকে চলে যায়, শূন্য খাঁচা যদি পৃথিবীর মধ্যে পড়ে থাকে। তাহলে কি দাম সেই মাটির খাচার! এই জীবনের মূল্য কোথায়। তাইতো এই গানগুলো আমাদের জীবনের কথা বলে, মাটি ও মানুষের কথা বলে, এই গানের মাধ্যমেই আমাদের অতীত ঐতিহ্য প্রকাশ পায়। সেই বিখ্যাত গানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, বাংলাদেশে প্রতিবছর আয়োজিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টিভ্যাল। পঞ্চমবারের মতো এবারও পালিত হল লোকসঙ্গীতের মহা আসর ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট ২০১৯। ১৪ই নভেম্বর থেকে ১৬ই নভেম্বর আর্মি স্টেডিয়ামে তিন দিনব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এবারও ফোকফেস্টের আয়োজন করেছিলেন সান ফাউন্ডেশন।
এই বিষয়ে আগেই আয়োজকরা জানান যে লোকসঙ্গীত-ই হবে দেশ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার নতুন উপলক্ষ্য। এমন অনুপ্রেরণা থেকে পঞ্চমবারের মতো হয় ফোক ফেস্টের আসর। এবারও দর্শকরা আগের মতোই বিনামূল্যে শুধুমাত্র অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি সরাসরি উপভোগ করেছেন। তবে আমরা জানি যার শুরু আছে তার শেষও আছে। তাই প্রাণের অনুষ্ঠান ফোক ফেস্ট ও শেষ হলো। সুর, লয়, তাল, ছন্দে মাতিয়ে শেষ হয়েছে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট-২০১৯। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়াম ভর্তি হাজারো দর্শক-শ্রোতাদের সুরের উন্মাদনায় মাতিয়ে গতকাল শনিবার রাত ১২টায় পর্দা নেমেছে উৎসবের পঞ্চম আসরের। সান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এবারের আসরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬টি দেশের ২০০ জনেরও বেশি লোকশিল্পী ও কলাকুশলী অংশ নিয়েছেন। উৎসবের প্রথম দিনে মঞ্চ মাতিয়েছেন বাংলাদেশের প্রেমা ও ভাবনা নৃত্য দল, শাহ আলম সরকার, জর্জিয়ারর শেভেনেবুরেবি এবং ভারতের দালের মেহেন্দি।
দ্বিতীয় দিনে আগত দর্শক-শ্রোতাদের সুরের উন্মাদনায় ভাসিয়েছেন বাংলাদেশের শফিকুল ইসলাম, কামরুজ্জামান রাব্বি, কাজল দেওয়ান, ফকির শাহবুদ্দিন, মালির হাবিব কইটে এবং পাকিস্তানের হিনা নাসরুল্লাহ। তাদের গান শুনে মন ভরে গেছে হাজারো দর্শকের।
শেষ দিনে প্রথমেই মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী মালেক কাওয়াল। চার দশকের বেশি সময় ধরে কাওয়ালি গান পরিবেশন করছেন তিনি। ওস্তাদ মরহুম টুনু কাওয়ালের কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন তিনি। কাওয়ালি গানের পাশাপাশি মাইজভাণ্ডারী গানেও বেশ পারদর্শী তিনি। সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে মঞ্চে আসেন তিনি। ‘ইশকে নবী’, ‘গাউছুল আজম ভাণ্ডারী’, ‘আমার বাবা মাওলানা’, ‘ভিখারী মেরি’ সহ কয়েকটি কাওয়ালি এবং মাইজভাণ্ডারী গান পরিবেশন করেন তিনি। তারপর মঞ্চে আসেন রাশিয়ান কারেলিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সাত্তুমা’। তারপর মঞ্চ মাতাতে আসেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় লালনসঙ্গীত শিল্পী চন্দনা মজুমদার। চাতক ভক্তিতে ভোলাবেন সাই, ধন্য ধন্য বলি তারে, সিন্নি খাওয়ার লোভ, তুমি জানো নারে প্রিয়, মুর্শিদ পরশ মনি গো, যাও পাখি বলো তারে শিরোনামে গানগুলো গেয়ে হাজারো দর্শকের পিপাসা মিটিয়েছেন তিনি। তার পরিবেশনার স্টেডিয়ামে ভিন্ন রকম পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন বয়সের সঙ্গীত পিপাসুরা তার সাথে তালে তাল মিলিয়ে গান গেয়েছেন। টানা ৪৫ মিনিট মঞ্চ মাতিয়েছেন চন্দনা মজুমদার।
শেষটা হয় ভিন্ন আমেজে। পরিবেশনা নিয়ে আসেন পাকিস্তানের জুনুন। জনপ্রিয় সব গান নিয়ে টানা এক ঘণ্টা মঞ্চে ছিলেন তিনি। জুনুন উপমহাদেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে এক উন্মাদনার নাম। পাকিস্তানি এই ব্যান্ডটি সুফি ঘরানার গান দিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে শ্রোতাদের মন কেড়ে আসছেন। তবে হ্যাঁ উৎসব প্রথম দুইদিনের তুলনায় শেষ দিনে সঙ্গীতপিপাসুদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। পুরো স্টেডিয়াম ছিল বিভিন্ন বয়সের আগতের দ্বারা পরিপূর্ণ। আগত দর্শকদের উপচেপড়া ভিড় আর বাঁধভাঙা উল্লাস প্রমাণ করে এদেশের মানুষ লোকগানকে কতটা ভালোবাসেন। আধ্যাত্মিকতা আর মাটির ঘ্রাণে গড়া লোকসঙ্গীত। আমাদের বড় আপন, হূদয়ের কাছাকাছি তার বাস। শিকড়ের এই টান বাংলা লোকগান বেঁচে থাকুক, ছড়িয়ে পড়ুক সারা পৃথিবীতে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিনগুলোতেও সেই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে চায় সান ফাউন্ডেশন।