কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
উনিশ শতকের ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ব্যান্ডের সূচনা ঘটে। ১৯৬৪ সালে শুরু হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের কার্যক্রম। তখন অবশ্য বাংলাদেশ নয়, পূর্ব পাকিস্তান ছিল। রামপুরার টিভি ভবনে গিয়ে ১৯৬৫ সালে অর্থাৎ টেলিভিশনের যাত্রার এক বছরের মাথায় পপ গানের অনুষ্ঠান করেন, জিঙ্গা শিল্পী গোষ্ঠী। নাজমা জামান এবং তাঁর ভাইবোনেরা তখন থাকতেন চট্টগ্রামে। ১৯৬৩ সালে নাজমা জামানের বড় ভাই সাফাত আলী খান-বোন শায়লা, নাজমা জামান ও তাঁর ভাবী মিলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই জিঙ্গা শিল্পী গোষ্ঠী নামে একটি ব্যান্ড তৈরি করেন। এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড। যখন জিঙ্গা শিল্পী গোষ্ঠী বাংলাদেশের পপ সাম্রাজ্যে একাই রাজত্ব করেছেন, সেই সময় আবির্ভূত হন একদল তরুণ গায়ক গায়িকা। যারা বাংলাদেশের গানের ভুবনকে পাল্টে দেন। এরা হলেন – আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীর, ফিরোজ শাঁই এবং পিলু মমতাজ। তাঁদের সবার বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তাঁরা টেলিভিশন এবং ঢাকা কেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে সারা দেশে ওপেন এয়ার কনসার্ট করতে থাকেন। জিঙ্গা শিল্পী গোষ্ঠীর পর আরও অনেক ব্যান্ড এসেছে এবং চলেও গেছে কিন্তু তারপর ১৯৭৩ সালে ‘উচ্চারণ’ ও ‘স্পদন’ এবং ‘সোলস’ -এর যাত্রা শুরু হয়। এরপর ‘৮০দশকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে! সেই সময় আবির্ভাব হয় খুলনা থেকে জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘অবসকিউর’-এর। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের গান করে থাকেন। রোমান্টিকতো আছেই সেই সাথে সামাজিক বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বাদ যায় না তাঁদের গানে। সেই ‘৮০দশক থেকে শুরু করে, ত্রিশ বছরের ওপরে এই ব্যান্ড এখনো তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে শ্রোতাদের কাছে। এই জনপ্রিয় ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও ভোকালিস্ট সাইদ হাসান টিপু’র সাথে সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে কথা বলে জানা গেল, তাঁর বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে ও ব্যান্ড নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।
অবসকিউরতো অনেক আগের ব্যান্ড। ‘৮০ দশকের ব্যান্ড, তাইনা!
হ্যাঁ, ‘৮৫ সালের ব্যান্ড অবসকিউর।
মাঝখানে তো বেশ কিছুদিন এই ব্যান্ডের কার্যক্রম বন্ধ ছিল, এর কারণ কি ছিল ?
আমি দেশে ছিলাম না। দেশের বাইরে ছিলাম।
এই ব্যান্ড নিয়ে তখন আর কিছু করেননি ?
না, না। আবার যখন দেশে ফিরেছি তখনও ১৯৯২ থেকে ২০০০ প্রায় ৮বছর কোনো কাজ করিনি।
আপনার যে গানের প্রতি উৎসাহ, যেমন- আপনি গান করবেন, ব্যান্ড তৈরি করবেন! এই অনুপ্রেরণাটি আপনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন ?
আমি আসলে ছোটবেলা থেকেই খেলাঘর -এর সাথে যুক্ত ছিলাম। গান শুরু ওখান থেকেই। তাছাড়া বড় বোন গান শিখতেন আমি তাঁর গান শুনতাম। তখন থেকেই গান বাজনার প্রতি আমার ঝোঁক। বলতে পারেন ওখান থেকেই আমার অনুপ্রেরণা।
ওই সময় আপনার বয়স কত ছিল ? পরে আপনি কি গানের ওপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছিলেন ?
না, না, আমি কখনোই গান শিখিনি। খেলাঘর করি যখন তখন আমার বয়স ৭/৮ বা ৯ বছর হবে।
তখন থেকেই কি চিন্তা ছিল আপনি গায়ক হবেন ?
না, না, ওইভাবে কখনোই চিন্তা করিনি যে আমি গায়ক হব!
তাহলে আপনি কি হতে চেয়েছিলেন ?
ওইভাবে কখনোই চিন্তা করিনি। পড়াশুনা করেছি পড়াশুনার মত। ইন্টারমিডিয়েট যখন পাশ করলাম, তখনই এই ব্যান্ড তৈরি করা। তার আগে না! তখন ওইরকম কোনো ব্যাপার ছিল না, আমি গান গাইব বা গায়ক হব।
আপনার বড় বোন কি এখনো গান করেন ?
না, না উনি গান করেন না। অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন।
আমি তাহলে কবে থেকে ধরতে পারি যে, আপনি গান জগতে এসেছেন ?
১৯৮৫ সাল থেকে। প্রফেশনালই আমি ১৯৮৫ সাল থেকেই গান করি।
এই সঙ্গীত জগতেতো অনেক কিছুই আছে গান ছাড়া, যেমন-যন্ত্রশিল্প। আপনি গানকে বেছে নিয়েছেন। গান ছাড়া অন্য কোনো যন্ত্রশিল্পের প্রতি কি আপনার কোনো আগ্রহ আছে ?
না, না, আমি কিছুই বাজাইনা। আমি শুধু গান গাই।
কখনো কি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেছেন ?
নাহ! না।
তাহলে কি আমি বলতে পারি, আপনার এই গানের ভয়েস ‘গড গিফটেড!
তা হতে পারে! কারণ আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কখনোই গান শিখি নাই। সারেগামা করে গান শেখা হয়নি কখনো।
আপনি কি ফিল্মে কখনো গান করেছেন ?
ফিল্মে একটি/দুটি গান করেছি। এস আই টুটুলের গান করেছি ফিল্মে।
ফিল্মের নামটি কি মনে আছে ?
না! ফিল্মের নাম মনে নেই।
কত সালে করেছেন ?
এটা ছিল ২০০৭/৮-এর দিকে।
আপনাদের তো অনেক জনপ্রিয়তা! ভক্ত শ্রোতাদের অনেক ভালবাসা পেয়েছেন এবং অনেক অনুষ্ঠানে হয়তো আপনাদের অনেক সুখকর স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা আছে। কখনো কি গান করতে গিয়ে, কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন ?
তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, সেটা চিটাগাং-এর একটি শো করতে গিয়ে। যাদের শো করতে গিয়েছি, সেই পার্টির আগেও একটি শো করেছিলাম। তখন কোনো সমস্যা হয়নি বরং শো’টাও খুব ভালো হয়েছিল। পরেরবার ওরাই আমাদের শো করতে ডাকল। আমরাও গেলাম শো করতে। আমরা তাদের কাছ থেকে আগে মানে এডভান্স কোনো টাকাপয়সা নেই নাই। আমরা ওখানে গিয়ে হোটেলে উঠেছি। সবকিছু ঠিকঠাক। শো করার পরে আর পার্টিকে খুঁজে পাইনা! কেউ নেই। হা হা হা। তিক্ত অভিজ্ঞতা মানে, ভয়ংকর অভিজ্ঞতা!
পার্টির নামটি কি বলা যাবে!
আমার এখন মনে নেই, ওরা কারা ছিল! কারণ ওরা আর জীবনেও যোগাযোগ করেনি।
তারপরে কি করলেন এই ভয়ংকর অবস্থায় ?
তারপরে যেটা করেছি, যখন কাউকেই পেলামনা চিটাগাং-এরই একটা বাসায় বোধহয় জন্মদিন বা একটা কিছু হবে, ওখানে শো করে ১০/১২ হাজার টাকা পেলাম। সেই টাকা দিয়ে হোটেলের বিল দিয়ে তারপর আমরা ঢাকায় ফিরি। এটা ছিল আমাদের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা।
এখন সফটওয়্যারের সাহায্যে অনেক গানের কাজ হচ্ছে, এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
সফটওয়্যারে কাজ হচ্ছে ভালো কথা! কিন্তু সফটওয়্যার দিয়ে তো আর গান গাওয়া হয়না! এখন ধরেন, সফটওয়্যারের সাহায্যে যিনি গান করেন আসলে তাঁকে গায়কের মধ্যে ধরা যায়না। অটোটিউনের যে গলা ইউজ করে, তাঁকে আমি গায়ক বলি কি করে ? অন্য কিছু যা হচ্ছে তা ঠিক আছে। কারণ ওয়ার্ল্ড এগিয়ে গেছে তারসাথে আমরাও এগিয়ে গেছি। টেকনোলজি অ্যাডাপ করেছি কিন্তু গানটিতো গাইতে জানতে হবেরে ভাই!
হুম! ঠিক তাই। অনেকেই দেখা যায় এভাবে অনেক কিছু করে ফেলছে।
যখন কেউ লাইভে কোথাও গাইতে আসে তখন বুঝা যায়, কি গায়! আর রেকর্ডিংতো অন্য জিনিস। রেকর্ডিং-এ আমরা অনেক কিছু করতে পারি গলা দিয়ে। কিন্তু লাইভে আপনি কতটুকু ভালো গাইতে পারেন সেটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা।
আপনি যদি গায়ক না হতেন তাহলে কোন্ দিকে আপনার ইন্টারেস্ট ছিল ?
গায়ক না হলে কি হতাম! এটা আসলে কখনোই চিন্তা করিনি।
তারমানে আপনি গান নিয়ে চিন্তা করেছেন ?
গান নিয়েও চিন্তা করিনি। গানটা হচ্ছে মনের ভেতর থেকে, ভালো লাগা থেকে গান। আর তা নাহলে একটা কিছু তো হতাম। জানিনা কি হতাম! আর অন্যভাবেও আমার চিন্তা ছিলনা, আমি ডাক্তার হবো বা ইঞ্জিনিয়ার হবো কারণ আমি কমার্স নিয়ে পড়াশুনা করেছি। তাই এমন কোনো চিন্তাভাবনার ব্যাপার আমার মধ্যে ছিলনা। ভাবতাম, যেভাবে দিন যাচ্ছে,সেভাবেই চলে যাবে। আমার চিন্তাধারা খুব সাধারণ।
মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায় -এই জনপ্রিয় গানটির গীতিকার কে ?
এই গানটির গীতিকার হচ্ছে এহসান নামের খুলনার একটি ছেলের আর সুর আমার করা।
তাহলে তো আপনার কাছে জানতে চেয়ে লাভ নেই! কারণ যে লিখেছেন, সে কি চিন্তা করে লিখেছেন ?
নাহ! সে এখন বেঁচে নেই, মারা গেছেন।
মারা গেছেন! খুবই দুঃখিত হলাম, খবরটি জেনে। আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।
আপনার পরিবারে কে কে আছেন ?
আমার পরিবারে আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের দুই বাচ্চা। এক মেয়ে আর এক ছেলে।
আপনার তো কর্মব্যস্ততা অনেক। যেমন একটা শো করতে গেলে রাতদিন পার হয়ে যায়। এই ব্যাপারটাকে আপনার পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে ভাবী কিভাবে নেন ?
আপনার ভাবী বা বাচ্চারা ঢাকার মধ্যে কোনো শো হলে, ওরা সবসময়ই আমার সাথে যায়। আর ঢাকার বাইরে হলেও যায় তবে যেখানে ওদের নিয়ে যাওয়া যায়। আমি সব সময় চেস্টা করি তাঁদেরকে নিয়ে যেতে।
আপনার ছেলেমেয়ের বয়স কেমন এখন ?
বড় হয়ে গেছে! একজন ১৯ বছর আরেকজন ১৬ বছর বয়স। মেয়ে বড়। মেয়ে আগামী বছর, জানুয়ারি মাসে চলে যাবে দেশের বাইরে পড়াশুনা করতে।
আপনার ব্যান্ড নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ?
ব্যান্ড নিয়ে পরিকল্পনা হল, আমরা প্রতি বছর যেভাবে একটা করে এ্যালবাম বের করে যাচ্ছি, সেভাবেই বের করে যাব।
আপনাদের সর্বশেষ এ্যালবাম কোনটি ?
‘টিটোর স্বাধীনতা’ -২০১৯ সালে মানে এই বছর বের হয়েছে।
পরবর্তীতে আপনাদের নতুন এ্যালবাম কি ধরনের হবে ?
নতুন এ্যালবামের কাজ এখনো শুরু করিনি। আগামী বছর মার্চ/এপ্রিলের দিকে কাজ শুরু করবো হয়তো। প্রতি বছর এ্যালবাম করার পাশাপাশি আমাদের আসলে এখন ব্যান্ড নিয়ে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রচার করা জরুরী। ঐ জন্যই একটা করে এ্যালবাম নিজেদের খরচে তৈরি করে আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে চালাচ্ছি। আর পাশাপাশি শো যেগুলো হয়, সেগুলি করছি।
এর মধ্যে আপনাদের ব্যান্ড অবসকিউর -এর দেশের বাইরে কোনো শো আছে কি ?
না, দেশের বাইরে এর মধ্যে কোনো শো নেই।
ইউটিউবে এত এত ভিউয়ারস এক একজন সঙ্গীত শিল্পীর, ব্যাপারটা আপনি কিভাবে দেখেন ?
আপনার উত্তরটা আমি দিয়ে দিচ্ছি! এখন ইউটিউবে আমার কয়েক মিলিয়ন ভিউ হোলো কিন্তু আমি গানের গ’ও জানিনা! তো এই ভিউর তো কোনো মানে নাই। আসলে আমি শিল্পী কিনা সেটা আমার পরিচয় হয় কোথায় গিয়ে ?
আমার পরীক্ষা হয় কোথায় ? যখন আমি লাইভে গান গাই তখন বুঝা যায়, আমি শিল্পী না শিল্প! তাই ইউটিউবে কত ভিউ হোলো এটা কোনো ম্যাটার না।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্য। আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য আমার ও সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে শুভচ্ছা রইল।
আমার পক্ষ থেকেও এবং সঙ্গীতাঙ্গন এর জন্য রইল অনেক শুভকামনা।