মোশারফ হোসেন মুন্না।
হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস
দম ফুরালেই ঠুস
তবু তো ভাই কারোরই নাই
একটু খানি হুশ।
হায়রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস।
গানের কথাটি পড়ে প্রথমে যার কথা মনে হলো সে হলো আমাদের সঙ্গীত জগতের গায়ক সম্রাট, সবার মাথার তাজ এন্ড্রু কিশোর। যার নামে নয় গানেই ভক্তের ভক্তি চলে আসে। বাংলাদেশের প্লেব্যাক সম্রাট বলা হয় তাকে। একজন শিল্পীর জীবনে জনপ্রিয় গান বলতে দুই চারটি থাকে কিন্তু এন্ড্রুকিশোরকে প্লেব্যাক সম্রাট বলার কারণ সর্বাধিক সিনেমার গানে কন্ঠ দেন এবং তার জনপ্রিয় গান অগণিত। সেই গান থেকে একটা জনপ্রিয় গানের কিছু কথা উপরে দিয়েছি। এন্ড্রুকিশোর এই গানটি সম্পর্কে বলেন, এটা আমার জীবনের একটি অবিস্মরণীয় গান। এই গানের জন্য আমি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই ১৯৮২ সালে। তিনি বলেন ‘বড় ভাল লোক ছিলো’ সিনেমার গান এটি। তবে আজ যদিও প্রতিবেদনটি কিশোরকে নিয়ে কিন্তু গানটির সাথে আরো একজন জড়িয়ে আছে যার নামের আগে সব্যসাচী লেখা হয়। তিনি হলেন প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক। এন্ড্রু কিশোর বলেন গানটি লেখা হক সাহেবের। সবাই সৈয়দ শামসুল হককে হক সাহেব বলে ডাকতেন। আর গানটির সুর করেছিলেন জনপ্রিয় সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার আলম খান। কিশোর বলেন আসলে হক ভাই গান লিখতেন না তখন। এই ফিল্মের প্রোডাকশন ‘শাওন সাগর’ ওই সময়ের বড় এবং খুবই শিক্ষিত প্রোডাকশন হাউস ছিল। তাদের অধিকাংশ ফিল্মেই মোটামুটি বার্তা থাকত এবং নান্দনিক ছিল। এই ফিল্মের পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেব একজন নামী প্রফেসর ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত। উনার বয়স অনেক হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করা হলো। যেটা দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে, যাতে শেষ বয়সে উনি পুরস্কার পান এবং সম্মান পান।
আর সত্যি সত্যি অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল এই ছবি। সে হিসেবে হক ভাইকে গান লিখতে দেওয়া হয়েছিল। আজ আমাদের মাঝে হক সাহেব নেই। আজ এন্ড্রুকিশোর এর জন্মদিনে গানটি দিয়ে তার অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ
করতে গিয়ে হক সাহেবের কথা মনে হলো। আলম খান গানটি বিষয়ে বলেন, আমার এখনো মনে আছে, তখন কিশোর আমার বাসায় বসে আছে, হঠাৎ এই গানটি নিয়ে উপস্থিত হলেন হক সাহেব। গানটি দিয়ে বললেন, আলম সাহেব গান তো লিখতে বলেছেন। কিন্তু গান তো লিখি না আমি। লিখতে চাইও না। কারণ, যাই লিখতে যাই তা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন লিখে শেষ করে ফেলেছেন! কথাটি শুনে আমি একটু হাসি দিলাম। হক সাহেব বলেন, যদি নতুন কিছু না দিতে পারি, তাহলে তো লিখে লাভ নেই। আমি অনেক চিন্তা করে একটা ছোট্ট জিনিস লিখে এনেছি, জানি না এটা আপনার কেমন লাগবে। তবে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কেউই এই শব্দগুলো তাঁদের গানে ব্যবহার করেননি। এই কথাটা শুনেই আমার মন বলছে দেখিতো কেমন গান লিখছে হক সাহেব। হক সাহেব বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি গানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারি, তাহলে এই গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার দিতে বাধ্য। কারণ, এ ধরনের গানের কথা আগে হয়নি। আপনি যদি আমার চাওয়া মতো সুর করতে পারেন, তাহলে আপনিও পুরস্কার পাবেন। আমার আগ্রহ যেন আরো বেড়ে গেলো। পরক্ষণেই হক সাহেব বলেন, আপনি যাঁকে দিয়ে গাওয়াবেন, তাঁর ১০০ পার্সেন্ট লাগবে না, ৬০ পার্সেন্টও যদি গাইতে পারে, তাহলে সেও জাতীয় পুরস্কার পাবে নিশ্চিত।
অবাক করা বিষয় হলো, গানটি গাওয়ার পর শামসুল হক সাহেবের সব কথা সত্যি ফলে গিয়েছিল। গানটিতে সবাই পুরস্কার পেয়েছিলো। এই বিষয়ে এন্ড্রু কিশোর বলেন, যখন বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরি প্রসন্ন
মজুমদারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো, তখন তাঁরা দুজনই আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁদের কথা হলো, তাঁরা দুই গীতিকার সেই সাম্রাজ্যবাদের পর থেকে আধুনিক গান নিয়ে এত গবেষণা করেছেন, তবুও এসব শব্দ তাঁরা খুঁজে পাননি এবং যাঁদেরকে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল ভাবা হয়, তাঁরাও এসব শব্দের ব্যবহার করেননি। ‘তো, এই গীতিকার ছেলেটি কে?’ প্রশ্ন করলেন। আমি হেসে বললাম, ‘ছেলেটা না, উনি একজন ভদ্রলোক। আমাদের দেশের প্রখ্যাত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। এসব কথা যেন আজ ইতিহাস হয়ে গেছে। হক সাহেব নাই, এন্ড্রুকিশোর আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে বিদেশে চিকিৎসা চলছে। আলম খানও কোন রকম আছেন। আমরা এন্ড্রুকিশোর এরজন্মদিনে তার এই গানটিকে মনে ধারণ করে বলতে চাই বেঁচে থাকুক কিশোর আরো এমন ধরণের গান আমাদের উপহার দিতে। সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে প্রার্থনা সুস্থ সুন্দর দেহ নিয়ে দেশের মাটিতে ফিরে আসুক।