– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
একজন শিল্পী গান গাইল এবং সেই গানটি জনপ্রিয় হল কিন্তু একটি গানের পেছনে কত যন্ত্রশিল্পী যে কাজ করে, তার খবর কিন্তু আমরা কেউ রাখিনা! বেশ কিছুদিন আগেতো শিল্পীরা গানের সুরকার আর গীতিকারের নামটিও বলতেন না। যাই হোক এখন সেটা বলার চর্চা হয়েছে। যন্ত্রশিল্প ছাড়া কখনোই একটি গান শ্রুতিমধুর হতে পারেনা। কথায় আছে জর্দা ছাড়া যেমন পান ভালো লাগেনা, তেমনি তবলা ছাড়া গান। সঙ্গীতাঙ্গন সবসময়ই চায় গানের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাঁদের সবার কথা তুলে ধরতে! তাইতো আজকে ব্যান্ড সঙ্গীতের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ফিডব্যাক’ -এর স্বনামধন্য গুণী ড্রামার এনাম এলাহী টন্টির সাথে সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে রহমান ফাহমিদার আলাপচারিতা তুলে ধরা হল।
আপনি কোন বয়স থেকে ড্রামস শিখা শুর করেছেন এবং ড্রামার হিসেবে আপনার আত্মপ্রকাশের শুরুটা কখন থেকে ?
আমার ক্লাস এইট থেকেই ড্রামস শেখার ঝোঁক ছিল। তখন আমরা চিটাগাং-এ থাকতাম। আমার বড় ভাই আহসান এলাহী ফান্টি এবং আমি, দুজনে অনেক কষ্ট করে ড্রামস শিখি। ১৯৮১/৮২ সালে আমার একটি ব্যান্ড ছিল, বলতে পারেন আমার জীবনের প্রথম ব্যান্ড। ব্যান্ডটির নাম ছিল ‘স্পার্ক’। ওখান থেকেই আস্তে আস্তে বাজানো শুরু।
তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, ওখান থেকেই ড্রামার হিসেবে আপনার শুরু। এরপর কি আর কোথাও বাজিয়েছেন ?
জী, এরপর চিটাগাং-এ আমি, পার্থ দা আমরা একটি ব্যান্ড ‘ম্যাসেজ’ করেছিলাম, সেখানে বাজিয়েছি। চিটাগাং-এ আরেকটি ব্যান্ড ছিল’রুটস’ সেখানেও বাজিয়েছি। তারপর ১৯৯৬-তে আমি ঢাকায় চলে আসি এবং ব্যান্ড ‘আর্ক’ এ জয়েন করি। ১৯৯৬ থেকে ‘৯৭ পর্যন্ত আমি আর্ক ব্যান্ডে ছিলাম তারপর ২০০০ সালে আমি ‘ফিডব্যাক’ -এ জয়েন করি এবং সেই থেকে এখন পর্যন্ত আমি ‘ফিডব্যাক’ এ আছি।
গানের জগতে অনেক কিছু করার ছিল, যেমন-গিটারিস্ট হওয়া, তবলা, পিয়ানো, অন্যান্য যন্ত্র বাজানো, এমনকি গায়ক হওয়া! এত কিছু থাকতে ড্রামার হতে ইচ্ছে হল কেন ?
আসলে ছোটবেলা থেকেই আমাদের দু’ভাইয়ের ড্রামস এর প্রতি একটা ফ্যাসিনেশন ছিল। ভাবতাম এই জিনিসটা কি করে বাজায়! আমরা যখন আমাদের ওস্তাদের বাসায় যেতাম এবং দেখতাম সে খুব সুন্দর করে বাজাচ্ছে, তখন আমাদের কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগতো। অনেকেই গান গাচ্ছে, গিটার ও অন্যান্য বাদ্য বাজাচ্ছে কিন্তু ড্রামস বাজানোর মধ্যে আলাদা একটা ব্যাপার আছে। বলতে পারেন, এই যন্ত্রটার প্রতি আমাদের দু’ভাইয়ের আলাদা একটা ঝোঁক ছিল।
আপনার ওস্তাদের নামটি যদি বলতেন।
আমার ওস্তাদ ছিল মানিকছড়ির মং-রাজার নাতি। তাঁর নাম ছিল’গুলু’। তাঁর বড় ভাই মঙ্গু চট্টগ্রামের জনপ্রিয় বেজ গিটারিস্ট ছিল। তাঁদের পরিবারটি ছিল মিউজিশিয়ান পরিবার।
আপনাদের পরিবারে আপনারা দু’ভাই ছাড়া আর কেউ কি ছিল এই গান বাজনার সাথে জড়িত ?
আমার পরিবারে আমাদের ছোট চাচা ছিল। সে গানবাজনা করতো সেইসাথে তবলা ও পিয়ানো বাজাতো। বলতে পারেন তাঁর প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা এই মিউজিকে আসি। আমিও তখন কঙ্গো বাজাতাম। কঙ্গো বাজাতে বাজাতেই ড্রামসে প্রতি মন চলে গেল। তা সেই অনেক আগের কথা। চাচা আর নেই এখন, মারা গেছেন! আল্লাহ্ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
আপনারা কয় ভাইবোন ?
আমরা দু’ভাই ও দু’বোন। বড় বোন মারা গেছেন। তারপর আমার বড় ভাই আহসান এলাহী ফান্টি। এরপর আমি আর আমার ছোট এক বোন।
আপনি ব্যান্ড ছাড়া ফিল্মে কি কোনো কাজ করেছেন ?
না, না,আমি ফিল্মে কোনো কাজ করিনি তবে আমার বড় ভাই আহসান এলাহী ফান্টি কাজ করত ফিল্মে। সে রিদম কম্পোজার ছিল। সবাই তাঁকে চিনে। সে অডিওতে কাজ করত সারগম এবং সঙ্গীতার আন্ডারে অনেক কাজ করেছে। আমি করিনি, আমি শুধু ব্যান্ডেই ছিলাম। আমি বেবী নাজনীন আপার সাথে ২০০০ থেকে ২০০২সাল পর্যন্ত বাজিয়েছি। তিনি আমাকে ছেলের মত দেখতো। দুই/তিন বছর তাঁর ম্যানেজার হিসেবেও ছিলাম।
ড্রামস বাজাতে গিয়ে কি কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন কখনো ?
হা হা হা! তিক্ত অভিজ্ঞতা তো অনেক কিছুই আছে তবে আগে ভালো অভিজ্ঞতার কথা বলি, তা হল যখন আর্কে ছিলাম তখন আমাদের গার্ড দিয়ে মঞ্চে নিয়ে যেত। তখন খুব সম্মানিতবোধ করতাম। আর খারাপ অভিজ্ঞতা ছিল এরকম যে, অনেকেই ড্রামস বুঝতনা তখন তারা ভুয়া ভুয়া বলে চিৎকার করত! সেই সময় খুব খারাপ লাগতো এবং কষ্ট পেতাম এই ভেবে যে, আমরা এত কষ্ট করে এসেছি কিন্তু তারা আমাদের কষ্টটাকে বুঝলোনা।
আপনাদের তো অনুষ্ঠানের জন্য প্রায়ই ঢাকার বাইরে যেতে হয় এবং অনেক সময় রাতদিন কাজ করতে হয়, এই ব্যাপারটাকে আপনার পরিবার কিভাবে দেখে ?
এটা আমাদের পরিবার খুব সাপোর্ট দেয়। বাবা মা সাপোর্ট দিয়েছেন। আমার ওয়াইফও দেয় এমনকি আমার মেয়েও দেয়। আমার অনুষ্ঠান দেখে মেয়ে বলে ঐ যে বাবা বাজাচ্ছে, বাবাকে দেখা যাচ্ছে। এই যে ফিলটা তা আমাকে খুব আনন্দ দেয়। সবাই সাপোর্ট না দিলে তো এতটুকু আসতাম নাহ!
আপনার কয় ছেলেমেয়ে ?
আমার একটি মেয়ে। নার্সারিতে পড়ে।
আপনি ড্রামার না হলে কি হতেন ?
আমি ড্রামার না হলে কি হতাম! আসলে আমরা মিউজিকটাকে নেশা হিসেবে নিয়েছি, পেশা হিসেবে নেইনি। মিউজিককে আমরা পেশা হিসেবে নেইনি কারণ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আগে সুযোগ সুবিধা ছিল কিন্তু এখন মিউজিককে পেশা হিসেবে নিলে না খেয়ে মরতে হবে। আমাদের নিজস্ব বাইয়িং হাউজ আছে তাই দেখাশোনা করছি মিউজিকের পাশাপাশি।
আসলে বাংলাদেশের যে যন্ত্রশিল্প তা পেশা হিসেবে নেয়া যায় না, কেন ? বেশ কিছুদিন আগে আরেকজন যন্ত্রশিল্পীও এই ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব মতামত জানিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে আপনার নিজস্ব মতামত যদি জানাতেন।
আমি ম্যাডাম আপনাকে বলি, বর্তমানে যন্ত্রশিল্পীদের যে অবস্থা! অনেককে দেখি তো, খুব কষ্ট লাগে। আগে তাঁদের যে দাম ছিল এবং মূল্যায়ন করা হত, এখন আর তাঁদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়না। বরঞ্চ তাঁরা কে কি অবস্থায় আছে ? কেউ জানতেও চায় না, বুঝতেও চায়না, খুঁজতেও চায়না। এইযে কষ্টটা! এই কষ্ট আমরা তো দেখেছি। তাই আমরা চিন্তা করছি, আমাদের এই মিউজিকের পাশাপাশি কিছু একটা করা দরকার। আমি, যারা যন্ত্রশিল্পী তাঁদের সবাইকে বলি বাজাও তবে তার পাশাপাশি কিছু একটা কর। কারণ তুমি যদি এই যন্ত্র দিয়ে কিছু একটা না করতে পারো তবে না খেয়ে মরতে হবে।
ড্রামস শিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ কিভাবে বাড়ানো যায় বলে আপনি মনে করেন ?
এটার জন্য ভালো ভালো ইন্সটিটিউট হওয়া দরকার। নাচ, গান, গিটার, পিয়ানো, তবলা এবং অন্যান্য যন্ত্র শেখার ইন্সটিটিউট আছে। ড্রামসের কোনো ইন্সটিটিউট নাই। আমার মনে হয় ড্রামস, কঙ্গো, পারকাশন এগুলোর জন্য যদি একটি ভালো ইন্সটিটিউট হয়, তাহলে ভালো সাপোর্ট পাওয়া যাবে এবং এগুলোর আউটপুট ভালো পাওয়া যাবে। অনেকেরই হয়তো আগ্রহ আছে কিন্তু ভালো ইন্সটিটিউট নাই দেখেই শিখতে চাচ্ছেনা।
এমনও তো হতে পারে শিখতে চাচ্ছেনা হয়তো দামের কথা ভেবে! কারণ আমরা জেনেছি সরোদ শিখতে গেলে কেউ, দামের কথা ভেবে পিছিয়ে যায়। ড্রামসের দাম কেমন ? এটাকি সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে পড়ে!
সরোদের অনেক দাম! তবে ড্রামস বিভিন্ন ক্যাটাগরির আছে – ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত আবার ৪০ লাখ টাকারও আছে। তবে বাংলাদেশে শেখার জন্য যেটা দরকার সেটা ২০/৩০ হাজার বা ৪০/৬০ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। আগে পাওয়া যেতনা। আগে খুব কঠিন ছিল এই যন্ত্র হাতের নাগালে পাওয়া। এখন সহজলভ্য হয়ে গেছে। আরেকটা ব্যাপার, এখন সেকেন্ডহ্যান্ড ড্রামসও পাওয়া যাচ্ছে।
ড্রামসের জন্য প্রশিক্ষক হিসেবে আপনি কি কিছু করতে চান ?
অবশ্যই করতে চাই। আমি চাই এই লাইনে ভালো ভালো ড্রামাররা আসুক। ড্রামস বাজালে আর শিখলে হবেনা! যেমন আমি শুধু ভিডিও দেখে ফলো করে ড্রামস শিখলাম, পিটাপিটি করলাম আর ড্রামার হয়ে গেলাম! ইটস নট কল ড্রামার। শিখতে হলে অবশ্যই ড্রামসের কিছু বেসিক জানতে হবে। ড্রামসের বেসিক কিছু আর্ট আছে, সেই আর্টগুলো জানতে হবে। আমরা স্টাফ নোটেশন শিখিনি কিন্তু বেসিক যেগুলো শিখেছি যেমন – ক্লাসিক্যাল কিছু আছে রেগি আছে, বোসানামা আছে, ওয়ালস, চাচা আছে, সিক্সটিন আছে। এগুলো অনেকে জানেনা নাম। অনেকে জানে হেভিমেটাল, হার্ডড্রপস এগুলো জানে। তাই জানার জন্য বেশী বেশী প্র্যাকটিস করা উচিত।
আমার মনে হয় এজন্য আপনাদের বেশী বেশী অনুষ্ঠান করা দরকার ড্রামস নিয়ে।
একটা ড্রামাসের অনুষ্ঠান করেছিল শুধু মাত্র ড্রামারদের নিয়ে। অনুষ্ঠানটি ভালো হয়েছিল কিন্তু আমার কথা হল, সবকিছু নিয়ে যদি কিছু একটা করা যায় যেমন -ওয়ার্কশপ। মাঝে মাঝে ওয়ার্কশপ হলে সবার উপকার হত। আপনারা এই ওয়ার্কশপের জন্য লিখবেন।
অবশ্যই লিখব কারণ সবকিছুর জন্যই প্র্যাকটিসের দরকার আছে। তাই ড্রামস শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই ওয়ার্কশপের প্রয়োজন। আশা করি সকলে এই বিষয়ের ওপর নজর দিবেন। আপনার এবং আপনার ব্যান্ডের জন্য রইল সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা।
আমার তরফ থেকে আপনার এবং সঙ্গীতাঙ্গন এর জন্যও রইল অনেক শুভকামনা।