– কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
ওস্তাদ গাজী আব্দুল হাকিম বিশ্বের সেরা বাঁশীবাদক, যাকে কিনা দ্যা ম্যাজিক্যাল অফ ফ্লুট (The Magical of Flute) বলা হয় এবং সে শুধু যে একজন বাঁশীবাদক তাই নয়! সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তী শিল্পী সুবীর নন্দীর অনেক কাছের মানুষ ছিলেন তাই তিনি সুবীর নন্দীকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন –
গাজী আব্দুল হাকিম – সুবীর নন্দীর মত বড় মাপের শিল্পী আর হবেনা। তিনি অনেক প্র্যাকটিস করেছেন এবং অনেক কষ্ট করেছেন। কষ্ট না করলে তো এ পর্যায়ের শিল্পী হওয়া যায় না! তাইতো তিনি এত সুন্দর গান করতেন।
সঙ্গীত যে একটি গুরুমুখী বিদ্যা তা তিনি শিখিয়েছেন। তিনি নিজে গান শিখেছেন অনেক বছর। একসময় অনেক কঠিন কঠিন গান তিনি করেছেন। অনেক স্বনামধন্য গীতিকার সুরকারের গান তিনি করেছেন, যেমন – খান আতাউর, শেখ সাদি খান, সত্য সাহা, আলী হোসেন সাহেব, খন্দকার নুরুল আলম, আব্দুল আহাদ প্রমুখ। তাইতো তিনি অনেক সুন্দর সুন্দর গান উপহার দিয়েছেন। এখনতো যে যার মত গান করে কিন্তু আগের শিল্পীরা সুরকারের কাছ থেকে কয়েকদিন ধরে গান প্র্যাকটিস করে শিখে বুঝে নিত, তারপর তাঁরা ফিল্ম, টেলিভিশনে, রেডিওর জন্য গান রেকর্ডিং করতো। সুবীর নন্দীর সাথে আমার নিজের ভাইয়ের মত সম্পর্ক ছিল। একই সংগে বহু কাজ করেছি এবং একই সংগে দুজনের পথচলা। তাঁর অসংখ্য গানের সাথে আমি বাজিয়েছি। তাঁর জীবনের প্রথম আধুনিক বাংলা গানের যে ক্যাসেটের এ্যালবাম বের করেছেন ঝংকার রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে, ঐ গানগুলোতেও আমি বাজিয়েছি। তাঁর ফিল্মের গানে, রেডিও, টেলিভিশনে, বিভিন্ন মিডিয়াতে এমনকি দেশ বিদেশে তাঁর গানের সাথে আমি বাঁশি বাজিয়েছি।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনি যেহেতু তার সাথে অনেক কাজ করেছেন এবং তাঁর সাথে ভাইয়ের মত সম্পর্ক ছিল তাই এমন কোনো স্মরণীয় স্মৃতি আছে কি, যা আপনার মনে দাগ কেটে আছে ?
গাজী আব্দুল হাকিম – হ্যাঁ, মনে দাগ কেটে আছে এরকম অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে! তার মধ্যে লন্ডনের একটি স্মৃতির কথা বলছি, আমরা একটি বিশাল গ্রুপ নিয়ে লন্ডনে বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল-এ যাই। সেখানে সুবীর নন্দীও আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি ওখানে একটি গান করেন, গানটি আমার খুব মনে আছে ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো’। সুবীর নন্দী অনেক যন্ত্র বাজাতে পারতেন। মাঝে মাঝে উনি আর আমি বাঁশি শেয়ার করে বাজাতাম। দুইজনের বোঝাপড়া খুব সুন্দর ছিল। লন্ডনে তাইই হয়েছিল। লন্ডনে ঐ গানটি গাওয়ার পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানটি সবাই শুনতে চাইত আর তিনি তার ভক্তদের কথা রাখতেন। আরও একটি স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে ১৯৯৫ সালে একটি বড় ট্যুরে ইন্ডিয়াতে যাই। দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে মহুয়া নামে একটি ড্যান্স ড্রামা সো হয় তখন সুবীর নন্দী ‘নদের চাঁদের’ গানগুলি গেয়েছেন আর ফেরদৌস আরা ‘মহুয়ার’ গানগুলি গেয়েছেন। লাইভ অনুষ্ঠানটি এত সুন্দর হয়েছিল যে ওখানকার মিনিস্টার এবং বড় বড় ব্যক্তিগণ অবাক হয়ে গিয়েছিল এই ভেবে যে, সেটি লাইভ ছিল তা তাদের বিশ্বাসই হচ্ছিলনা। তারপর আমরা যখন কোলকাতায় আসি অনুষ্ঠান করতে তখন একদিন আমি আমার মেয়ের জন্য হারমোনিয়াম কিনব, আমার সাথে সুবীর নন্দীও ছিলেন। দুজনে মিলে একটি হারমোনিয়াম কিনলাম। তারপর থেকে যখনি তিনি আমার বাসায় আসতেন তখনি সেই হারমোনিয়াম বাজাতেন আর বলতেন, আমি এত দামি দামি হারমোনিয়াম কিনেছি কিন্তু এটার মত এত ভাল আর সুন্দর হারমোনিয়াম দেখি নি! এখন এই হারমোনিয়াম দেখলে তাঁর কথা মনে পড়ে। কত কথা, কত স্মৃতি ভোলার মত নয়!
সঙ্গীতাঙ্গন – ব্যক্তি হিসেবে আপনি সুবীর নন্দীকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন ?
গাজী আব্দুল হাকিম – সুবীর নন্দী অনেক অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। যদিও তিনি ব্যাংকার ছিলেন তবুও সঙ্গীতটাকে আকড়ে ধরে ছিলেন। আমরা একবার ইন্ডিয়ার শিলচরে বেড়াতে যাই সিলেটের পুরো একটি গ্রুপ। সেই গ্রুপে ছিলেন, তপন দা, পটল বাবু, মলয় কুমার গাঙ্গুলি। তখন সেখানে শিলচরের ফরিংবাদে সুবীর নন্দীর এক বড় ভাই থাকতেন। তিনি আমাদের দাওয়াত করে খাওয়ালেন। আমাদের সাথে সুবীর নন্দীরও যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ব্যাংক থেকে ছুটি পাননি তাই তাঁর যাওয়া হয়নি। যাই হোক আমরা যখন তাঁর ভাইয়ের বাসায় সবাই মিলে খেতে বসেছি তখন তাঁর ভাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, গাজী ভাই, আপনার সাথে তো আমার পরিচয় ছিলনা কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথে আপনার অনেক ছবি আমার বাসায় বাঁধানো আছে। আমার ভাই আমাকে ছবিগুলো পাঠিয়েছে। আমি দেখলাম সুবীর নন্দীর সাথে আমার অনেক ছবি তাঁর বাসার দেয়ালে বাঁধানো আছে। সুবীর নন্দীর অনেক কথা আমার মনে পড়ে। হুমায়ুন আহমেদের গানগুলি যখন গেয়েছেন আমি তাঁর সাথে বাজিয়েছি। ও আমার উড়াল পঙ্খীরে – গানটির কথা খুব মনে পড়ে। যাই হোক! উনি মারা গেছেন বলার তো কিছু নেই, সবাইকে যেতে হবে তবে জাতিকে বহুকাল অপেক্ষা করতে হবে আরেকজন সুবীর নন্দী তৈরি করতে। আগামি পঞ্চাশ বছর বা এক’শ বছরে আর একজন সুবীর নন্দী আসবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে আমি রহমান ফাহমিদা আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। শুভকামনা রইল।
গাজী আব্দুল হাকিম – সঙ্গীতাঙ্গন ও আপনার জন্যেও রইল অনেক অনেক শুভকামনা। সুবীর নন্দীর জন্য দোয়া করবেন।