– কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
সত্তর ও আশির দশকের আলোচিত কণ্ঠ শিল্পী লীনু বিল্লাহ’র কাছে সদ্যপ্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী সুবীর নন্দীর স্মৃতিচারণ করতে বলা হলে তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন…
লীনু বিল্লাহ – ১৯৬৪ সনে আমরা কচিকাঁচারমেলা থেকে একটি অনুষ্ঠান করার জন্য সিলেটের শ্রীমঙ্গলে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের সাথে ছিলেন, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, হাশেম খান প্রমুখ। তখন খুব শীতের দিন ছিল। শ্রীমঙ্গলে সকালবেলায় একটি অনুষ্ঠান ছিল। আমি তখন তবলা বাজাই আবার গানও করি। সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি একটি ছোট ছেলে আমার চেয়ে দুই এক বছরের ছোট হবে, দেখতে খুব ফর্সা! সাদা হাফপ্যান্ট শার্ট পড়া, হারমোনিয়াম বাজিয়ে অসাধারণ একটি গান গাইলো। আমি তাঁর গান শুনে তখনি বল্লাম, এই ছেলে বড় হয়ে সারা বাংলাদেশ কাঁপিয়ে দিবে এবং তাইই হয়েছে। সেদিন থেকেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব শুরু হল। স্বাধীনতার পর ওর সাথে আমার তেমন একটা দেখা হয় নাই। ১৯৭২ সালে ওর সাথে আমার রেডিও বাংলাদেশে দেখা। আমি তখন সেখানে চাকুরীরত আর সুবীর নন্দী সেখানে নিয়মিত গান করে এবং রেডিও থেকেই ওর শুরু। রেডিও কিন্তু প্রথম সুবীর নন্দীকে আবিষ্কার করে। রেডিও বাংলাদেশ এবং সিলেট রেডিওতে সে নিয়মিত গান করতো। সেই সময় থেকেই সুবীর নন্দীর সাথে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হল এবং তখন থেকেই ও আমাকে গোঁসাই ডাকতো আর আমি ওকে গোঁসাই ডাকতাম।
গত বছর ২৮শে এপ্রিল একই ফ্লাইটে ও আর আমি কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসি। তখন ওকে দেখে বলেছিলাম, তুমি এত কষ্ট করছো! নিজের প্রতি যত্ন নিও। কারণ সুবীর সপ্তাহে তিনদিন ডায়াালেসিস করতো। ১৯৯৭/৯৮ সালের দিকে ও খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমরা ওর চিকিৎসার জন্য বিশাল একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। সেই সময় ও মারাত্মক অসুস্থতার থেকে ভালো হয়ে আবার ফিরে আসে। ব্যক্তিগতভাবে বলবো,সুবীর নন্দীর মত শিল্পী বাংলাদেশে আসতে দু’শ বছর লাগবে। আদৌ আসবে কিনা সন্দেহ আছে। আর ওর মত ভালো মানুষ এবং ঐ পর্যায়ের শিল্পী মনে হয় না আসবে, অসম্ভব!
সঙ্গীতাঙ্গন – ব্যক্তি ও মানুষ হিসেবে সুবীর নন্দী কেমন ছিলেন জানতে চাওয়া হলে লিনু বিল্লাহ বলেন – ব্যক্তি ও মানুষ হিসেবে সুবীর নন্দী ছিলেন অসাধারণ! আমি যখনি কল করে বলতাম, সুবীর গোঁসাই তোমার গান শুনতে ইচ্ছা করতাছে, তুমি কই আছো ? তখন ও বলতো, আমি এখানে আছি, আমি আসতেছি। লীনু বিল্লাহ বলেন, আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, এমন অনেক ঘটনা হয়েছে যে, রাত্রি দুইটার সময় আমরা কোনো আড্ডায় আছি ধরেন বিশ পঁচিশ বছর আগের কথা, সেখানে গান-বাজনা হচ্ছে হঠাৎ করে সুবীর নন্দীকে কল করলাম, গোঁসাই তুমি কই ? সে বল্ল, আমি বাসায়। আমি বললাম কি কর তুমি? আমাদের তো তোমার গান শুনতে ইচ্ছা করতাছে, তুমি কি আসতে পারবা ? সে বল্ল হ্যাঁ, আসতেছি। কোথায় তোমরা ? আমি ঠিকানা দিয়ে দিলাম সে ঠিকই একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে চলে এসেছে। সারারাত আমরা গান করেছি এবং হৈ চৈ করেছি। সেই দিনগুলো ভোলার মত না। আমি কোনোদিন ভুলতে পারবোনা! তাছাড়া আমার বাসায় প্রায়ই গানের অনুষ্ঠান হত এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানে সুবীর নন্দী আসতোই। আমাকে বলতো, গোঁসাই তোমার বাড়িতে আজকে যে অনুষ্ঠান হবে, আমি তবলাবাদককে নিয়ে আসব, একে নিয়ে আসব, তাকে নিয়ে আসব। এমনকি যদি শিল্পী লাগে বল, আমি নিয়ে আসব। আমি বললাম দরকার নেই, আমার বাসায় সবাই গান গাইতে আসবে এবং তোমার গান শুনতে সবাই আসবে, তো শিল্পীর কোনো অভাব নেই। সে এইভাবে গানবাজনায় সহযোগিতা করতো। আমার বাসায় এবং বিভিন্ন স্থানে গান নিয়ে ওর সাথে অসাধারণ অনেক স্মৃতি আছে যা ভোলার মত না।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনাদের দুজনের একত্রে গান নিয়ে কোনো কাজ করা হয়েছে কি, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন –
লীনু বিল্লাহ – না, সেরকম কোনো কাজ করা হয় নাই। সুবীর নন্দী অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে নিয়ে গানের কাজ করতে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের একসাথে কাজ করা হয় নাই কারণ যখন ওর সময় হতো তখন আমার সময় হতোনা, আবার আমার সময় হলে ওর হতোনা। কিন্তু দুজনে দুজনের গান শুনতেছি। ও গত বছর আমেরিকায় যাওয়ার আগে একটি গান সুর করে দিয়ে গেছে আমাকে। ঈদের পর ইনশাআল্লাহ্ ঐ সুর নিয়ে কাজ করবো।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি এবং আমাদের আরো নতুন নতুন গান উপহার দিবেন আর পরবর্তীতে গান নিয়ে আপনার সাথে আরও অনেক কথা হবে সেই আশা নিয়ে আজকের মত বিদায় জানাচ্ছি। শুভকামনা রইল।
লীনু বিল্লাহ – সঙ্গীতাঙ্গন ও আপনার জন্যেও রইল অনেক অনেক শুভকামনা।