মেধাস্বত্বের কপিরাইট পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। শিল্পী সমাজ এ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কিন্তু সম্মিলিত কোন আয়োজন নেই সোচ্চার হতে। সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু গত বছরের আগস্টে বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, পাইরেসি বন্ধ না হওয়ায় গান বানানো ছেড়ে দেওয়ার কথা! অভিমানী এই শিল্পী জানিয়েছিলেন, কম্পিউটারের দোকানে দশ টাকা দিলেই কয়েক হাজার গান দিয়ে দেয় সিডি, পেনড্রাইভ, মোবাইল বা অন্য কোনো ডিভাইসে। সেখানে গান করে আর কী হবে ? পাইরেসি বা কপিরাইট নিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি অনেকটা ক্লান্তবোধ করতেন। তার মতে, যে তিন হাজার গান করতে গিয়ে তিন লক্ষ ফোঁটা ঘাম ঝরিয়েছে তারা ধনী হয়নি, কেউ ধনী হয়নি। মাঝখানে একটি সাম্রাজ্য ভেঙে গেছে।
এ পরিস্থিতি যে শুধু সঙ্গীত জগতে, তা নয়। গবেষকদের মতে, মেধাস্বত্ব আইনের দুর্বলতায় জামদানি, হস্তশিল্প, ওষুধসহ ২৮টি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য, সফটওয়্যার ও টেলিকম শিল্প, চামড়া খাতও হুমকির মুখে। পাইরেটেড পণ্য এড়িয়ে চলার আহ্বান সাধারণের মাঝে সাড়া ফেলছে না। বাজারে নকল পণ্যের ছড়াছড়ি। আসল বা নকল বোঝা দায়। দেশীয় টুথব্রাশের দাম ৪৫ টাকা। অথচ আমদানি করা টুথব্রাশ বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। এগুলো আসছে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। মেধাসম্পদ অধিকার প্রতিষ্ঠা বেশ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। সহায়ক নীতিমালা ও আইনি কাঠামো প্রয়োজন। বাংলাদেশের অনেক পণ্য এখন রফতানি হয়। মেধাস্বত্ব অধিকার কার্যকর
করতে না পারলে, ক্ষতির মুখে পড়বে এসব শিল্প ও সেবা।
এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেধাসম্পদ অধিকারের ভিত্তিতে একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, শুধু বস্তুগত পণ্যেই নয়। মেধাস্বত্ব সুরক্ষা নতুনত্বকে উৎসাহিত করে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সহযোগিতা
করে থাকে। বর্তমান বাজার অর্থনীতি বস্তুগত সম্পদ, উদ্ভাবন এবং জ্ঞান দ্বারা চালিত। সৃজনশীল ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি উদ্ভাবনী সমাজ নিশ্চিত করার জন্য, মেধাসম্পদ অধিকারের পর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রয়োজন। প্রযুক্তির সুবিধায় গান,চলচ্চিত্র এবং বই বিনামূল্যে ডাউনলোড হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির মালিক। এটি অর্থনৈতিক কাঠামোগত দুর্বলতা।
এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে, ১৭৯০ সালের ৩১ মে যুক্তরাষ্ট্র কপিরাইট আইন চালু করে। ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিকভাবে ‘মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি’ দেওয়া হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপ চুক্তিতে এই কনভেনশন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যার ফলে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। চুক্তির বিধান বাস্তবায়ন করতে ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রণয়ন করা হয় ‘কপিরাইট আইন’। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিল্পসম্পদ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক; কপিরাইট নিবন্ধন ঐচ্ছিক।
বাংলাদেশও এই ধারায় চলছে। এতে অনেকের নিবন্ধনে আগ্রহ নেই। মাত্র ৭২টি চলচ্চিত্রের কপিরাইট নিবন্ধন হয়েছে। মেধাসম্পদের নিবন্ধন হয়েছে ১৫ হাজার। বিদ্যমান আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন বেশ জটিল হয়ে পড়েছে।
‘ই-কপিরাইট সেবা’র ব্যবস্থা আছে দেশে, কিন্তু তা জানেই বা ক’জন। এর ফলে কপিরাইট অফিস থেকে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে। কিন্তু তাতে কপিরাইটের জন্য আবেদন তেমন বাড়ছে না। সৃজনশীল কর্মের নৈতিক ও আর্থিক অধিকার অর্থাৎ মালিকানা সংরক্ষণ পদ্ধতিতে আমরা এখনও ব্যাপকভাবে সাড়া দিতে পারছি না। কপিরাইটের অফিস শুধুমাত্র ঢাকায়। এতে সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে কপিরাইট সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া কেবল ঢাকায় সম্ভব ছিল। আবেদনের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা সম্পর্কে আবেদনকারীর কাছে তথ্য না থাকায় কাগজপত্র জমা দেয়ায় ভুল হত এবং একাধিকবার অফিসে আসতে হতো।
এতে করে আবেদনকারীর খরচ ও যাতায়াত দুটোই বৃদ্ধি পেত। আবেদনের সব কাজ হাতে-কলমে সম্পন্ন হত বলে আবেদনকারীকে অনেক ভোগান্তির স্বীকার করতে হয়। এছাড়াও পূর্বে সনদপ্রাপ্ত কর্মের কোনো প্রকার ডিজিটাল
সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছিল না বলে বাছাই প্রক্রিয়া ভুল হবার সম্ভাবনা রয়েই যেত। ই-সার্ভিসে সেসব ঝক্কি নেই। দেশের যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, সংগীতকর্ম, রেকর্ডকর্ম,
শিল্পকর্ম, চলচ্চিত্র বিষয়ককর্ম, বেতার সম্প্রচার, টেলিভিশন সম্প্রচার, কম্পিউটার-সফটওয়্যারকর্ম ইত্যাদি নিবন্ধনের জন্যে সহজেই বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের ওয়েবসাইট -এ গিয়ে কপিরাইটের জন্যে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। প্রত্যেকটি আবেদন একটি স্বয়ংক্রিয় উপায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে এসএমএস এর মাধ্যমে নোটিফিকেশন প্রদান করা হবে এবং নির্দিষ্ট তারিখে কপিরাইট সার্টিফিকেট বিতরণ করা হবে। প্রয়োজনে ই-সার্টিফিকেটও পাওয়া যেতে পারে যা পরবর্তীতে অনলাইনে যে কোনো সময় যাচাই করা যাবে।
বেশির ভাগ সৃজনশীল মেধাসম্পদের কপিরাইট নিবন্ধন না করা বা এ ব্যাপারে লোকজনের আগ্রহ কম থাকা, ভালো লক্ষণ নয়। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হবে। কপিরাইট সম্পর্কেও অনেকের ধারণা অস্পষ্ট। ফলে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আইনি অধিকার থেকে। বেআইনি ফটোকপি বইয়ের জমজমাট ব্যবসা চলে। নিম্নমানের কাগজে ছাপানো এসব বই সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। নকল বইয়ের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নকল সিডি-ডিভিডির বাজারও। ফলে ক্রেতা বা ভোক্তারা লাভবান হলেও ক্ষতির মুখে পড়েন মেধাসম্পদের প্রকৃত মালিক ও উত্তরসূরিরা। কপিরাইট মানে কপি করার অধিকার নয়। কোনো সৃজনশীল কর্মের ওপর সৃজনকারীর নৈতিক এবং আর্থিক অধিকারই হচ্ছে কপিরাইট। এর মধ্য দিয়ে নিজের ও উত্তরাধিকারীর মালিকানা সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
আন্তর্জাতিক আইনে এর সুরক্ষা, নৈতিকতা এবং আর্থিক বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এটি মানুষের মৌলিক অধিকারের ভিত্তিমূল। এ ব্যাপারে সৃজনশীল কাজের সঙ্গে জড়িতদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর আইনি সুরক্ষা সম্পর্কে জানতে হবে। লাইসেন্সবিহীন কোনো গান যদি পাঁচতারকা হোটেলের লবিতেও বাজে তাহলে এর জরিমানা গুনতে হবে। কপিরাইট আইনে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করতে হবে। এ ব্যাপারে বোর্ডে দাখিলকৃত অভিযোগগুলোর দ্রুত
নিষ্পত্তি প্রয়োজন। কপিরাইট আইন কার্যকর হলে মানুষ কাজের মূল্যায়ন পাবে। এ ব্যাপারে সৃজনশীল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তরা ঐক্যবদ্ধ হলে মেধাস্বত্বের অধিকার সংরক্ষিত হবে। একই সঙ্গে হয়রানি কমে যাবে। দেশে চোরাই
সফটওয়্যারের বাজার বেড়েই চলছে। মেধাসত্ত্ব আইনে এই চৗর্যবৃত্তি রোধ করতে পারছে না। ইন্টারন্যাশনাল ডাটা কর্পোরেশনের সমীক্ষায় চোরাই সফটওয়্যারের দেশ হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছে আর্মেনিয়া ও বাংলাদেশ।
পাইরেসি স্টাডি নামে এই রিপোর্টে সারা বিশ্বের কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও আল্ট্রাপোর্টেবল পিসিতে ব্যবহৃত প্যাকেজ সফটওয়্যার পাইরেসির হার তুলে ধরা হয়েছে দেশভেদে। অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ, সিকিউরিটি প্যাকেজ, বিজনেস এপ্লিকেশন-এর মতো সিস্টেম সফটওয়্যার এবং রেফারেন্স সফটওয়্যার চুরি করে ব্যবহারের হার উঠে এসেছে। করপোরেট বাণিজ্যের এ যুগে মেধাস্বত্বের লড়াইটা বেশ জমজমাট। চীনের বিরুদ্ধে মেধাসত্ত্ব ও প্রযুক্তি চুরির অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেয়। চীনের রপ্তানির ওপর ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শুল্ক আরোপ করে তালিকা প্রকাশ করে মার্কিন সরকার। চীন যুক্তরাষ্ট্রে মূলত কারখানার যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি পণ্য, যেমন সয়াবিন, গাড়ি ও ছোট বিমান। টেলিভিশন অনুষ্ঠান চুরির দায়ে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা করেছে কাতার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় মেধাসত্ত্ব সম্পত্তি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। সৌদি আরবের কাছে এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়েছে ভুক্তভোগী কাতারভিত্তিক খেলাধুলা বিষয়ক চ্যানেল ‘বি-ইন’। কর্তৃপক্ষ বলেছে, কাতারের টেলিভিশন চ্যানেল ‘বি-ইন’-এর সম্প্রচার সৌদি আরবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বি-ইনের অনুষ্ঠান সৌদি আরবে নকল করে দেখানো হচ্ছে। এদিকে কম্পিউটারের বাজার বড় হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৭ সালে সারা বিশ্বব্যাপী পাইরেসি ৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। বড় দেশ ব্রাজিল, ভারত, চীন ও রাশিয়ায় পিসি শিপমেন্ট ২০০৬ সাল থেকে ২০০৭ সালে বেড়েছে ২৭ শতাংশ আর নর্থ আমেরিকাতে ১৩ শতাংশ।