– রবিউল আউয়াল।
পণ্ডিত সুদর্শন দাশ সঙ্গীত জগতে তবলাবাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও তিনি একজন ব্যারিস্টার। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পণ্ডিত সুদর্শন দাশ যুক্ত আছেন আইন পেশায়। তবলা বাঁজিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক অব রেকর্ডসে নাম লেখিয়েছেন পণ্ডিত সুদর্শন দাশ। তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশের একজন গর্বিত সন্তান। তবলা বিশারদ হিসেবে খেতাব প্রাপ্ত এই গুণী শিল্পী একটি নয় তিন তিনটি রেকর্ড গড়েছেন। গত ১০ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর শওকত আলী মিলনায়তনে ইনডেক্স মিডিয়ার স্টার পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাকে সংবর্ধনাও দেয়া হয়। সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্রকে ভালবেসে যুক্তরাজ্যে বসেই একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে তিনি নিয়মিত তবলায় তালিম দিয়ে থাকেন। তবলা বিশারদ পণ্ডিত সুদর্শন দাশের সাথে আলোচনা করে জানা যায় তার বেড়ে ওঠা ও সাফল্য গাঁথা কিছু কথা-
কেমন আছেন ?
ভাল আছি।
তবলা বিশারদ পণ্ডিত সুদর্শন দাশের গল্প জানার আগে জানতে চাই, কিভাবে শুরু হয় আপনার ছেলেবেলা ও তবলায় হাতেখড়ি ?
আমার জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়। আমার বাবার নাম অমূল্য রঞ্জন দাশ ও মায়ের নাম বুলবুল রাণী দাশ, ছোটবেলা থেকেই গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিলো। বলতে গেলে জন্মের পর থেকেই পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছি। আমার চার বছর বয়সেই তবলায় হাতেখড়ি হয়। আমার এক ভাই পেশায় চিকিৎসক, তিনিও তবলা বাঁজান। ভাইকে ছোটবেলায় তবলা বাঁজাতে দেখেই আমার ভালো লাগত। তারপর পুরোদমে তবলার তাল-লয়ে মগ্ন হয়ে যাই। আমি যখন কলেজের ছাত্র তখনই একবার আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পেয়েছি।
আপনাকে তবলা বিশারদ উপাধি দেওয়া হয় কখন ?
১৯৯২ সালে ভারতের শান্তিনিকেতনে চলে যাই। তারপর ১৯৯৭ সালে শান্তিনিকেতন থেকেই তবলা বিশারদ উপাধি দেয়া হয়। দেশে ফিরে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য চলে যাই যুক্তরাজ্যে কিন্তু মন পড়ে থাকে আমার তবলার কাছে। তারপর ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যে তবলা অ্যান্ড ঢোল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করি। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা আসতে থাকে। আমি এই একাডেমির প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তবলা বাঁজাতাম এবং ২০০৮ সালে ভারতে আন্তর্জাতিক তবলা প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদকও অর্জন করি।
তবলা বাঁজিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক অব রেকর্ডসে নাম লেখানো যেতে পারে, এমন ধারনা আপনার মাঝে কিভাবে জন্ম নিল ?
গল্পটা অনেক বড়। আমি ২০০৯ সালে জানতে পারি, ভারতের রামাকৃষ্ণাণ নামের এক ব্যক্তি টানা ৫০১ ঘণ্টা মৃদঙ্গ বাঁজিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। আমারও মনে হলো মৃদঙ্গ বাঁজিয়ে যদি বিশ্বরেকর্ড করা যায় তাহলে আমিও তবলা বাঁজিয়ে করতে পারবো। তারপর আমি খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম এবং জানতে পারলাম, তবলা বাঁজিয়ে এখনো কেউ রেকর্ড করেনি। তাই আমি ভেবেছিলাম যেহেতু তবলায় অন্য কোনো রেকর্ড নাই, সেহেতু ১০১ ঘণ্টা তবলা বাঁজালেও সেটি রেকর্ড হবে। এই ব্যাপারে আমার আগ্রহ আরো বেড়ে যায় এবং যোগাযোগ করি গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকডর্স কর্তৃপক্ষের সাথে। কিন্তু গিনেজ কর্তৃপক্ষ জানাল হস্তচালিত সব বাদ্যযন্ত্রকে একই ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করা হয়।
মৃদঙ্গ গলায় বেঁধে হেঁটে বা শুয়ে-বসে বাঁজানো যায়, কিন্তু রামাকৃষ্ণানের রেকর্ড ভাঙতে হলে একটানা বসে থেকে ৫০১ ঘণ্টার বেশি তবলা বাজাতে হবে, তাই সে যাত্রায় আর এগোনো হলো না। কিন্তু আমার স্বপ্ন যেন আমাকে সবসময় তাঁড়িয়ে বেড়াতো। তিন বছর পর আবারও গিনেজ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করি। রেকর্ড ভাঙার উদ্যোগ নেওয়ার অনুমতি চেয়ে, তবলা বাঁজানোর দৃশ্যধারন করে পাঠিয়ে দেই। অবশেষে প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত ১১ জনের মধ্য থেকে আমাকে একাই চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়ে দেয় গিনেজ কর্তৃপক্ষ। এবার নেমে যাই পৃষ্ঠপোষক খোঁজর কাজে। কিন্তু আগ্রহী স্পন্সর কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খাটাখাটনির পর স্পন্সর পাই এবং ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর শুরু করি আমার তবলা ম্যারাথন। তারপর টানা ২৫ দিন ৫৫৭ ঘণ্টা ১১ মিনিট তবলা বাঁজিয়ে লন্ডনে স্থানীয় এক অডিটোরিয়ামে আমার নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়া। তবলা বাঁজানোর পুরো দৃশ্যধারণ গিনেজ কর্তৃপক্ষকে জমা দেওয়ার পর মিলল স্বীকৃতি।
আপনি তো ঢোল ও তবলা বাঁজিয়েও রেকর্ড গড়েছিলেন। আমরা কি সে গল্পটা জানতে পারি ?
তবলায় বিশ্বরেকর্ড করার পর ঢোলেও রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন জাগলো। তারপর তবলায় রেকর্ড করার পর ঢোলে রেকর্ড করার জন্য একটানা ২৭ ঘণ্টা ঢোল বাঁজাতে হয়েছিলো। এটা ছিলো আমার গড়া দ্বিতীয় বিশ্বরেকর্ড। দুইটি রেকর্ড গড়ার পর ভাবলাম আরো একটি রেকর্ড গড়তে পারলে হ্যাটট্রিক হয়ে যেতো। ইচ্ছাটা প্রবল হতে থাকে। আমি তবলা ও ঢোল বাজাতে পারদর্শী হলেও কখনো ড্রাম বাজানো হয়নি। শুধুমাত্র রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে ড্রাম বাজানো শিখি। চলতি বছরের ৪ জুলাই সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত একটানা ১৪ ঘণ্টা ড্রাম বাঁজিয়ে লন্ডনের স্থানীয় এক মিলনায়তনে এই নতুন রেকর্ড গড়ি। এটি হয়েছিল ইউনিসেফের অধীনে এবং সেখান থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বেশকিছু অর্থও সংগ্রহ করা হয়েছিলো।
আপনি পেশায় আইনজীবি নাকি তবলাবাদক ?
আসলে আমার পেশা কোনটা বলা একটু কঠিন। তবুও বলতে হয়, আইনকে যদি আমার পেশা বলা হয় তবে তবলা আমার নেশা। আর যদি তবলাকে আমার পেশা বলা হয় তবে নেশাটাও হবে তবলা। তবে আমি যেহেতু একজন আইনজীবি, তাই নিয়মিত আইন চর্চা করছি। প্রতি সপ্তাহে একদিন কোর্টে যাই। তবে আমি আমার বেশির ভাগ সময় কাটাই নিজের তবলা অ্যান্ড ঢোল একাডেমিতে। এখানে বর্তমানে ৩৮৬ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে এবং পাশাপাশি লন্ডনের নিউহ্যাম কাউন্সিলে মিউজিক ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করছি। বর্তমানে যুক্তরাজ্য ছাড়াও তবলা অ্যান্ড ঢোল একাডেমির শাখা আছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, কলকাতা ও চট্টগ্রামে। তবে বাংলাদেশে আরো শাখা বাড়ানো হবে।
আপনার পেশা ও নেশা তবলা এবং তবলা অ্যান্ড ঢোল একাডেমিকে নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি ?
আমি আমার দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসি। তাই দেশে কিছু কাজ করার পরিকল্পনা আছে। সেই লক্ষ্যে আমি আমার তবলা অ্যান্ড ঢোল একাডেমিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। একাডেমিতে ভর্তির জন্য প্রচুর আগ্রহী শিক্ষার্থীরা ভিড় করছেন। তাই তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়াই আপাতত দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। আগ্রহীদের মধ্য থেকে যারা গান ও বাদ্যযন্ত্র অর্থাভাবে শিখতে পারে না, তাদেরকে বিনামূল্যে গান ও যন্ত্র শেখানোর পরিকল্পনা রয়েছে এবং তা খুব শীঘ্রই বাস্তবায়ন করা হবে।
তবলা বাঁজিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক অব রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন। আপনার এমন স্বীকৃতি অর্জনের অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলুন –
মানুষের জীবনে যে কোন স্বীকৃতি অর্জনই গৌরবের এবং আনন্দের। গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক অব রেকর্ডসের পর অনেক সংবর্ধনা পেয়েছি, অনেকেই অভিনন্দন ও অভিবাদন জানিয়েছেন। তবে গিনেজ বুকে নিজের দেশের নাম যুক্ত করতে পেরেছি, আর এটাই ছিল আমার সবচেয়ে আনন্দের। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। আমি আনন্দিত ‘আমার রেকর্ড গড়ার স্বপ্নপূরণ হওয়ায়’।
বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতা দেখিয়ে হাতে গোনা যে’জন বাংলাদেশী গিনেজ বুকে নাম লিখিয়েছেন, পণ্ডিত সুদর্শন দাশ তাদের মধ্যে অন্যতম।