– রাওদাতুল জান্নাত, জেনেভা।
বিশ্বায়নের এই যুগে সব কিছুই পরিবর্তনশীল, তাই বলে আবহমান কাল ধরে চলে আসা উৎসব মুখর বাঙালির প্রাণের বৈশাখ বরণের দৃশ্যপটের তারতম্য ঘটেনি কোথাও। বৈশাখ মানে যে শুধু নতুন বছরকে সাদরে বরণ করা,
তা নয়। আমার মনে হয় সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষা-ভাষী জাতিগোষ্ঠীর এক অপূর্ব মহা মিলন উৎসব ও বটে।
গত ১৪ এপ্রিল ১লা বৈশাখ ১৪২৫ বংগাব্দ জেনেভা বাংলা পাঠশালা ও সুইস বাংলাদেশ কালচারাল এসোসিয়েশনের উদ্যোগে প্রথম বারের মতো আলপনা আঁকা, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও এক মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের
মাধ্যমে নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নেয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, গত পাচ বছর যাবত জেনেভা বাংলা পাঠশালা দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে সংগতি রেখে প্রতিটা আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছিলো। বিগত দিনের অনুষ্ঠানগুলোকে
সুইজারল্যান্ড সরকারের অধীনে সাংস্কৃতিক বিভাগ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে এবারই প্রথম বারের মতো সুইস বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করেন; যা কিনা
জেনেভায় বসবাসরত সমগ্র বাঙালির জন্য ছিল পরম আনন্দের বিষয়। জেনেভা শহরের মুলকেন্দ্রে অবস্থিত স্থানীয় একটি প্রসিদ্ধ এলাকা ফরাসি ভাষায় যা ‘পাকী’ নামে পরিচিত।
এই ‘মেইজন দ্যা কেইতিয়ে দ্যা পাকী’ এসোসিয়েশনের পাঁচ বারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ বংশোদ্ভুত যুবক আরিনুল হক এর অক্লান্ত পরিশ্রম ও ফরাসি ভাষাভাষী সুইসদের যৌথ প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়। বাংলা পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রিয়াজুল হক এর পরিচালনায় পাঠশালার শিক্ষার্থীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানসহ বিভিন্ন ধরনের গান ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশকেই যেন তুলে ধরে। দর্শক সারিতে ছিলেন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের ভাষার মানুষ। পুরো অনুষ্ঠান জূড়ে তবলায় ছিলেন ইংল্যান্ড থেকে আগত বিখ্যাত তবলাবাদক উস্তাদ ইউসুফ আলী খাঁন। তার যাদুকরী তবলার সুরের মূর্ছনায় উপস্থিত দর্শক মহল ছিলেন বিমোহিত। নাচ, কোরিওগ্রাফী ও বেহালায় ছিলেন ফারানা হক, যার কথা আমি বিশেষ ভাবে বলতে চাচ্ছি। আরো বলতে চাচ্ছি, মিসেস নাসরিন হক, আরিনুল হক, স্বর্না হক এর কথা। যাদের অবদানে প্রতি বছর জেনেভায় কিছু স্বার্থক অনুষ্ঠান আমরা দেখতে পাই। পর্দার অন্তরালের মানুষদের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, একটা জিনিস তখনি সুন্দর আর স্বার্থক হয় যখন তাদের পরিশ্রম আর আন্তরিকতার পরিচয় সর্বত্র থাকে। শুধু একটা অনুষ্ঠান দিয়ে আমি এর বিচার করব না, সার্বিকভাবে বলতে গেলে, জেনেভা বাংলা পাঠশালার একজন অভিভাবক হিসেবে বলব, এই দূর বিভূঁইয়ে বসে দেশীয় কৃষ্টি, কালচারকে সযত্নে লালন করা, সহজ কথা নয়। বাচনভঙ্গী, উচ্চারণে সঠিকতা,
শিক্ষার্থীদের আচার ব্যবহার, সামাজিকতার মূল্যবোধ চারিত্রিক দৃঢ়তা গুণাবলী গুলো প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী এই বাংলা পাঠশালা থেকে ধারণ করে। নিয়মিত রেওয়াজ থেকে শুরু করে গলা সাধার ব্যাপারটি আমার খুব ভাল লাগে।
গান এবং নাচ পরিবেশনার ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে বলব, এক কথায় ছিল অসাধারণ। বিভিন্ন বয়েস ভেদে গান, নাচ নির্বাচন করে সেগুলু বাচ্চাদের নিয়ে তৈরি করা দিনের পর দিন খুব সহজ কথা নয়। দেশাত্ববোধক গান থেকে শুরু করে নজরুল, রবীন্দ্র, আধুনিক কোন গানেরই অভাব বোধ ছিল না। নাচ নিয়ে আলাদা করে বলার সাহস আমাকে দেখাতে হচ্ছে। কারন, আমার শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বলব, দেশীয় ফোক আধুনিক, ক্ল্যাসিকাল, পাহাড়ি
উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর নাচ সব মিলিয়ে এর আবেদন ছিল অডিটোরিয়াম এ উপস্থিত প্রত্যেকটি বিদেশী অতিথি বৃন্দের কাছে শতভাগ। তাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস আর স্বতঃ স্ফুর্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। আমরা জানি, নাচের মেকাপ আর গেট আপ খুবই ব্যয়বহুল, জেনেভায় বসে বিশেষত যেসব বাচ্চাগুলু এখানে জন্মগ্রহণ করেও দেশের মাটির সংস্কৃতিকে এতো চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পথ পরিক্রমায় আছে সুইস বাংলাদেশ কালচারাল এসোসিয়েশনের সমস্ত কার্যকরী সদস্য ও তাদের পরিবার পরিজনদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে বছরের শুরুতে আমরা এমন সুন্দর অনুষ্ঠান উপহার পাই। পুরো অনুষ্ঠানটি জুড়ে ফরাসি ও বাংলা ভাষায় সঞ্চালকের দ্বায়িত্বে ছিলেন য়্যানী (সুইস) ও তান রহমান (বাংলা)। জেনেভায় এবারকার বর্ষবরণ ঘিরে যে আলপনা ও মঙ্গল শোভা যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে, এতে করে সুইস ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে আদান প্রদান হয়েছে তাতে আমি বলব আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বেশি লাভবান হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন মত, ধর্ম, ও রাজনৈতিক মানুষের যে মেল বন্ধন দেখা গেছে তা সত্যই ছিল অনুকরণীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তার সাহিত্য কর্ম প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাঙালি জাতি শুধু বাংলা ভাষার জন্যই বাঙালি নয়, বাংলা কৃষ্টি, কালচার দিয়ে যে অপরের চিত্তলোকে গমন করতে পারে, সেজন্যই বাঙালি’।
আমার উপরের লেখার মূল বিষয় যেন এই দুই লাইনের মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে। কালো, অন্ধকার, সংকীর্ণ মন মানসিকতার মুখ ও মুখোশ গুলো বিসর্জন দিয়ে, পারস্পারিক ভেদাভেদ ভুলে, আমরাও পারি এই বিদেশ বিভুইয়ে এক বাংলার প্রাণ হয়ে গৌরবে দেশের মান ধরে রাখতে।
শুভ নববর্ষ -১৪২৫…