– রবিউল আউয়াল।
ফকির লালন সাঁই এর নামে অনুষ্ঠিত সাধুসঙ্গে দীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ (২০০৪-২০১৭) অংশগ্রহণ মূলক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে নির্মান করা হয়েছে ‘ভাবনগর’ প্রামাণ্যচিত্রটি। এই ‘ভাবনগর’ প্রামাণ্যচিত্রটি পর্যবেক্ষণ কালে সাধু-ফকিররাও এর নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠেছিলেন। সাধু-ফকিররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের তত্ত্ব, সাধনা ও সমাজ ভাবনা নিয়ে সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। প্রত্যেক প্রহরে পরিবেশিত সঙ্গীত তাৎক্ষণিকভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। সাধু-ফকিরদের সঙ্গে সেইসব আলাপচারিতা ও সঙ্গীতের মালা গেঁথে ‘ছবিঘর’ এর ব্যানারে মঞ্জুরুল হক নির্মাণ করেছেন ‘ভাবনগর’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র। মঞ্জুরুল হক নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটি পরিচালনার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীত পরিচালনা, চিত্রনাট্য ও সম্পাদনাও করেছেন এবং যৌথভাবে মঞ্জুরুল হক, প্রদীপ আইচ ও আব্দুল আজিজ চিত্রগ্রহণের কাজও সম্পন্ন করেছেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালী যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে লালনের গান বেশ জনপ্রিয়। শ্রোতার পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার করা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় লালনের খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় গানটির অবস্থান ১৪তম। আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব, প্রেম-ভক্তিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, মানুষ-পরমতত্ত্ব, আল্লা-নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ-গৌরতত্ত্ব এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে লালনের গান রয়েছে।
লালন (১৭৭৪-১৮৯০) বাংলার বাউল ঘরানার সর্বশ্রেষ্ট সাধক। লালন এর জীবন অষ্টাদশ শতকের শেষ প্রান্ত থেকে উনিশ শতকের শেষ প্রান্ত অবধি বিস্তৃত; জীবনভর যে সাধক কর্ষন করেছেন নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক সংগীতশস্য- যা একাধারে মরমী ও মানবিক। যে কারণে লালন-এর জীবন দর্শনই বাঙালির ভাবজগতের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে লালন এর ভাবদর্শন এক দিনে তৈরি হয়নি, সে জন্য বাংলার ভাব জগতে এক দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি চলছিল, যে প্রস্তুতিপর্বে ক’জন বাঙালি তত্ত্বদর্শী গভীর অবদান রেখে গেছেন। লালন তাঁর এক গানে সবিনয়ে তাদের মাহাত্ম বর্ননা করেছেন, এবং আমরা সেই গুরু-স্তুতির গভীরতায় বিস্মৃত হয়ে যাই।
‘ভাবনগর’ প্রমাণ্যচিত্রের মূল বিষয় বস্তু হলো ‘সাধুসঙ্গ’। দীর্ঘ চব্বিশ ঘন্টাব্যাপি এই সাধুসঙ্গ আট প্রহরে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রত্যেক প্রহরের আচার-আচরন, আলোচনা, সঙ্গীতের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু ভিন্ন ভিন্ন। যেমন – দৈন্যতা, গুরু-ভক্ত সম্পর্ক, কাম, প্রেম, রস, রতি, নারী-পুরুষ যুগল সাধনা, গোষ্ঠ লীলা, রাধা-কৃঞ্চ ও শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা সংকীর্তন, সমাজ ভাবনা ও যুগল মিলন। ভাবুক, পদকর্তা ফকির লালন সাঁই প্রায় দুইশত বছর আগে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়া গ্রামে দোল পূর্ণিমায় যে সাধুসঙ্গ শুরু করেছিলেন তা আজো প্রতি বছর তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা উদযাপন করে আসছেন।
ফকির লালন সাঁই তাঁর জগৎ-জীবন নিয়ে যে ভাবনা তার সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন এবং সেই সঙ্গীতই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশিত হয় সাধুসঙ্গে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লালন সাঁইয়ের ভক্তরা একত্রিত হয়ে তাদের গুরু লালনের আদর্শকে স্মরন করে থাকে। একই সাথে সাধু-ভক্তদের পারস্পারিক ভাব বিনিময়ের একটি উত্তম মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় এই সাধুসঙ্গ।
প্রামাণ্যচিত্রটির নির্বাহী প্রযোজক আয়েশা হক ও সহযোগী প্রযোজক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন। শব্দগ্রহণ করেছেন রবিউল ইসলাম নান্নু। মঞ্জুরুল হকের পরিচিতি: মঞ্জুরুল হক একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তিতে বিজ্ঞাপনী সংস্থা, নিউজ এজেন্সী ও কয়েকজন পরিচালকের সাথে পেশাদার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। সবশেষে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের চিত্রগ্রাহক ও সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারেক মাসুদের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর পর স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা ও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র ‘মৃত্যুফাঁদ’। একযুগ ধরে কাজ করে ২০১৭ সালে শেষ করেছেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র ‘ভাবনগর’। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে ডকু-ফিকশন ‘নিশঃস্ক চিত্ত’ এর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া মওলা বক্স নামে একজন বাউল শিল্পীকে নিয়ে নির্মাণ করছেন ‘ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণী’ নামে আরেক চলচ্চিত্র।