“প্রথমতো আমি ‘তোমাকে চাই
দ্বিতীয়তো আমি ‘তোমাকে চাই
তৃতীয়তো আমি ‘তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।”
কিছু কখনো ভোলা যায়না, কিছু সুর – গানের বানী চির অম্লান -চির অমর।
শ্রদ্ধেয় কবীর সুমন একজন খ্যাতিমান প্রেরণাময় গায়ক। উনার গান মানুষকে ভালোবাসা সহ জীবনের সঠিক বাস্তবতা শিখিয়েছেন।
কবীর সুমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উনার হৃদয়ের কিছু কথা তুলে ধরেছেন,
১৯৯২ সালে আমার লেখা সুর করা গানের প্রথম সংকলন ‘তোমাকে চাই’ প্রকাশ করেছিলেন গ্রামোফোন কম্পানি অফ ইণ্ডিয়া। তারপর কত কী ঘটে গিয়েছে। সেদিন আমার বয়স ছিল ৪৩। আজ আমি ৬৯ এ। রোজ ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলে দেখি। যতদূর মনে পড়ে এই চোখেই তো দেখতাম দুনিয়াটাকে এক্কেবারে ছেলেবেলায়। অথচ কত বয়স হয়ে গেল। কত কী পাল্টে গেল।
বাবা বলেছিলেন – তোকে যে আমরা সঙ্গীতশিক্ষায় উৎসাহ দিয়েছিলাম সেটা তুই পেশাদার শিল্পী হবি বলে নয়, ভাল শ্রোতা হয়ে উঠবি এই আশায়। সঙ্গীতকে পেশা করিস না, মানুষ বড় কষ্ট দেবে।
অস্বীকার করব না, সঙ্গীতকে পেশা করে মানুষের কাছ থেকে যে অকারণ অপমান ও আঘাত পেয়েছি তা বিস্ময়কর। এদিক দিয়ে বাবার কথা ঠিক বলেই মনে হয়।
কিন্তু অন্য একটা দিক দিয়ে দেখলে মনে হয় বাবা ঠিক বলেননি পুরোপুরি। সঙ্গীতের জন্য মানুষের যে ভালবাসা ও সম্মান পেয়েছি তার পরিমান অনেক গুণ বেশি।
‘তোমাকে চাই’ প্রকাশের ২৫ বছর পূর্তি আমার শ্রোতাবন্ধুরা যেভাবে উদযাপন করলেন মানুষের ইতিহাসে তা কবার হয়েছে কে জানে। এই উদযাপনের পেছনে কোনও রাজনৈতিক দল বা শিবির, সমিতি বা সংস্থার বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল না। যাদবপুর থেকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত শোভাযাত্রা। নানান বয়সের মানুষ সেখানে। স্বত:স্ফূর্তভাবে গান গেয়ে উঠছেন সকলে। তারই মধ্যে চলেছে সৃজনশীল নাচ।
সেই শোভাযাত্রায় আমি ছিলাম না। পরে ভিডিওতে দেখেছি। অবিশ্বাস্য। আমার নানান গানের লাইন লেখা পোস্টার, ব্যানার। জানি না কারা এত কাজ করেছেন। যাচ্ছেতাই গরম। তারই মধ্যে, ভিডিও দেখলাম, আমার পুরনো বন্ধু দেবীপ্রসাদ জলের বোতল হাতে ছেলেমেয়েদের কাছে যাচ্ছেন, জল খাওয়াচ্ছেন। গলায় ঝোলানো গিটার বাজাতে বাজাতে মিছিলে হাঁটছেন সৃজন, দেবর্ষি। হারমোনিকা বাজাচ্ছে অভিমন্যু। গ্রীষ্ম অপরাহ্ণের ক্লান্ত কলকাতার রাস্তা মাতিয়ে একা নেচে চলেছে হিয়া, আমার মেয়ে। আমার অসংখ্য ছেলেমেয়ে চিৎকার করে গাইতে গাইতে হাঁটছেন। দলমত নির্বিশেষে। সি পি আই এম, নকশালপন্থী, তৃণমূল সব এক জায়গায়। হিন্দু ফাশিস্তরা ছিলেন বলে শুনিনি। কিন্তু তাঁদের কোনও স্থানীয় বা রাজ্য নেতা যদি আমার গান গাইতে গাইতে এই শোভাযাত্রায় সকলের সঙ্গে পা মেলাতেন – কেউ আপত্তি করত বলে মনে হয় না। – কত দূর থেকে ছুটে এসেছেন কেউ কেউ। বারাসাত
থেকে রৌণক। উত্তরপাড়া থেকে রাহুল। আরও দূর থেকেও এসেছেন কেউ কেউ।
রাকাকে দেখে মনে হচ্ছে ও শুধু গাইছে না, নাচছেও। আমার আর এক কন্যা বুকুনও উপস্থিত গানে গানে। তৃণমূলের কাউন্সিলর অরূপ, আমারই এক ছেলে, গান গাইতে গাইতে চলেছে, পাশেই বামপন্থায় বিশ্বাসী এবং তৃণমূলবিরোধী আমার আর এক ছেলে রৌণক।
সকলে যখন ‘গড়িয়াহাটার মোড়’ গাইতে গাইতে আমাদের বাড়ির সামনে এলেন, দেখতে পেলাম এমন নবীনও আছেন যাঁদের জন্ম ১৯৯২ এর পর। তাঁদেরই পাশে তাঁদের পিতৃতুল্য আমার বন্ধু পরমেশ, ভাস্কর সেন, দেবীপ্রসাদ ঘোষ। সকলেই ঘেমে নেয়ে গেছেন। কিন্তু তারই মধ্যে কী আনন্দ সকলের।
মনে পড়ে যাচ্ছিল ১৯৯২ সালের একটি দিনের কথা। গ্রামোফোন কম্পানির দপ্তরে রবি কিচলু মহোদয় আমায় জানালেন তিনি আমার গান রেকর্ড করতে চান। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তিনি আমায় রেকর্ড করতে চাইছেন।
তিনি বলেছিলেন, “Son, I’ll be doing a service to Indian music.”
আজ পর্যন্ত যত গান বেঁধেছি, এই যে আমি আজ কায়মনোবাক্যে শুধু বাংলা খেয়াল তৈরি ও গাওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বেঁচে আছি এবং এইভাবেই কবরে যাব – এ-সবই তো ভারতীয়, বাংলার সঙ্গীতের পায়ে আমার অর্ঘ্য।
Whatever I am doing is a service to Indian and Bengali Music. I was born to serve Indian and Bengali Music.
এই যে এতজন আমার গান গাইতে গাইতে বাজাতে বাজাতে মিছিলে হাঁটছিলেন সেটাও তো আধুনিক বাংলা গানের জন্য। বাংলা গান ও সাধারণভাবে সঙ্গীতকে এভাবে উদযাপন করার নজির সম্ভবত এই প্রথম। এই কাজটাও দুনিয়ায় একমাত্র বাঙালীই বোধহয় পারে। – কবীর সুমন, ৩১ মে,২০১৭…