প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে দুর নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক
– তথ্য সংগ্রহে মীর শাহ্নেওয়াজ…
১) নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা | স্বাগত দে
https://www.youtube.com/watch?v=gV3EY2uEGnk
২) নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা | পাপিয়া
https://www.youtube.com/watch?v=7aVWGN-BdDs
৩) নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা | শচীন দেব বর্মণ
https://www.youtube.com/watch?v=_MX_Hw2Cuxc
শেখ ভানু’র ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা, নিশীথে যাইও ফুলবনে’ এই কালজয়ী গানটি দেশে বিদেশে সর্বজনীন জনপ্রিয়তার লাভ করেছে। গানটি পৃথিবীর অনেক ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই বিখ্যাত গানটির কথা আরো দুজন কবিকে উৎসাহী করেছে বলে অনেক গবেষকদের ধারণা। তাদের দুজনেরই কথায় কিছু রদবদল আছে। এ যেন এক ফুল, তিন মালী।
একটি গান, তিনজন গীতিকারঃ শেখ ভানু, রাধারমণ দত্ত ও জসীম উদ্দীন।
শেখ ভানু’র রচনা ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ দেহ ও সাধনতত্ত্বের গানটিকে শচীন দেব বর্মণ প্রেমের গানে রূপান্তর করলেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীনকে দিয়ে এবং রূপান্তরিত এই গানটি রেকর্ড করলেন ১৯৩৫ সালে। ২০১৭ সালেও গানটির আবেদন বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি।
অলংকার বর্জন করে ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বাউল, জারির সঙ্গে পশ্চিমী ফোক মিশিয়ে শচীন দেব বর্মণ বাংলা গানের অন্য এক ভুবন নির্মাণ করলেন। গলার বৈশিষ্ট্যও একটি প্রধান বিষয়। শচীন দেবের কণ্ঠ অনুনাসিক, ভাঙা, ভেতরে একটি স্বর বাজে, আছে বিলাপধ্বনি, ক্রন্দনাকুলতা, আছে ঝোঁক, নাটকীয়তা, আছে শব্দকে নিয়ে সুরের লহরী খেলানো, পল্লী বা লোকগীতির আঙ্গিকে সিদ্ধকাম এবং এসব একত্র করে তাঁর গান মার্জিত মৌলিক ও অননুকরণীয়।
গলার গঠনের একটা বাস্তব ভিত্তি আছে। তা সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ জলমাটি হাওয়াজাত কতকটা জাতি বা গোষ্ঠীগত কতকটা শারীরিকগত কতকটা বাকভঙ্গিগত। গলা ভাঙা, গলার লৌকিক অলংকার কোনো শহুরে ওস্তাদ হাজার রেওয়াজ করেও আয়ত্তে আনতে পারেন না। শহুরে কণ্ঠ লোকসংগীতের মেলডিক স্ট্রাকচারটা ঠিকই আয়ত্ত করতে পারেন কিন্তু কণ্ঠভঙ্গিটি আয়ত্ত করতে পারেন না। তাতে করে সেই গানে মাটির গন্ধটি পাওয়া যায় না, বড়ই আরবান মনে হয়। লোকসংগীত গুরুমুখী নয়, গণমুখী, ঘরানা নেই, আছে বাহিরানা। লোকসংগীতের ভাবানুষঙ্গটি সার্বজনীন, অনুভূতিও তাই।
এখানেই শচীন দেববর্মণের কৃতিত্ব। রাগসংগীত ও লোকসংগীতের মিশেলে অভিজ্ঞতা শ্রুতি, কল্পনা ও কারুকৃতির অন্তরবয়ানে একটা স্বতন্ত্র গীতভাষা তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন ঐতিহ্যের দায়কে অতিক্রম করে। তার গানের অনবদ্য আবেদন, স্বচ্ছতা ও সারল্য এখনো বাঙালিকে বুদ করে রাখে। এটাকেই পল রবসন হয়তো বলেছেন “মিউজিক অব দি পিপল”।
শেখ ভানু বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার ভাদিকারা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন (জন্ম ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ -মৃত্যু ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর পিতার নাম মুন্সি নাছির উদ্দীন। শেখ ভানু বাংলাদেশের একজন মরমী সাধক ও বাউল গানের কবি। তাঁর লেখা গানের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। শেখ ভানু’র গানের মধ্যে জনপ্রিয় অন্যতম গান হচ্ছে-
(১) আমি পারলাম না রে, আমার মনরে বুঝাইতে, তোমরানি দেইখাছো কেউ, কদম তলায় ফুল ফুইটাছে।
(২) নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা , নিশীথে যাইও ফুলবনে।
শেখ ভানু ছিলেন ধানের বেপারী। তিনি গ্রাম অঞ্চল থেকে ধান ক্রয় করে ভৈরব, মদনগঞ্জ, মোহনগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় বিক্রি করতেন। শেখ ভানু সুফীবাদের শিক্ষা লইতে বাগদাদ হতে বাংলাদেশে আগত দরবেশ মীরাণ শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।