প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে দুর নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক
– তথ্য সংগ্রহে মীর শাহ্নেওয়াজ…
শিল্পীঃ শাহনাজ বেগম ও আবদুল জব্বার সহ সমবেত কণ্ঠে
সুরকারঃ আনোয়ার পারভেজ
গীতিকারঃ গাজী মাজহারুল আনোয়ার
“জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়
কোটিপ্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে
নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়…”
এ গানটি শোনেনি এমন কোন বাঙালি নেই। এই গানটির মধ্য দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে হানাদার বধে এগিয়ে যায় বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সবশ্রেণীর জনতা। এই গানটি বাংলার মুক্তিপিপাসু মানুষের চেতনায় মুক্তির আগুন ধরায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে এই গানটিকে আরাধ্য করেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায় সমগ্র বাঙালি জাতি। গানটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস। যার কারণে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটিকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণসংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সিগনেচার টিউন বা সূচনা সংগীত, জাতীয় শ্লোগানও বটে। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার এই গানটি লেখেন।
এই গান সম্পর্কে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন,
“১৯৭০ সালের মার্চের দিকে লেখা হয় এই গানটি, তবে ঠিক তারিখ মনে নেই। তখন সময়টা ছিল উত্তাল, সবার প্রাণে একটাই চাওয়া – জয়। চোখের সামনে লাখো কোটি মানুষের একটাই চাওয়া, সেটি স্বাধীনতা। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। আমাদের হাতে কলম ছিল, আমরা কলম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। যার কাছে সুর ছিল, সে গান নিয়ে এসেছে। জহির রায়হান ক্যামেরা নিয়ে কাজে নেমেছেন। আসলে সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল এই স্বাধীনতা। তখন আসলে গানটি লিখতে হয়নি, এমনিতেই আমার কলম দিয়ে গানের কথা বেরিয়ে গেছে। ওই সময়ে প্রত্যেকটা মানুষের মনের কথাগুলো শুধু এক হয়ে একটি গান হয়ে গেছে।”
তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বঞ্চনা-দুর্দশা আর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার আশ্চর্য ছন্দময় কুশলতায় বাণীবদ্ধ করেছিলেন—’জয় বাংলা বাংলার জয়/হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়/কোটি প্রাণ একসাথে/জেগেছে অন্ধরাতে/নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়।’ অনন্যসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞায় নিপুণ দক্ষতায় গানটিতে সুর সংযোজন করেছিলেন আনোয়ার পারভেজ। মার্চের রিদমে রক্তে শিহরণ লাগানো, অনুরণন জাগানো অসম্ভব স্পার্কিং এই গানটি ছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের আকুতি। আশ্চর্য এক সম্মোহনী শক্তি রয়েছে এই গানটির সুর সংযোজনায়। যন্ত্রানুষঙ্গের অপরূপ বিন্যাস গানটিতে রোপণ করেছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অবিনাশী মন্ত্র।
জয় বাংলা – মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, স্বাধীনতার স্লোগান। ১৯৭১ সালের সবচেয়ে উদ্দীপক স্লোগান। প্রকৃত অর্থে এ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার সমার্থক শব্দ। জয় বাংলা স্লোগানটির আবির্ভাব ১৯৬৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখে সর্বপ্রথম উচ্চারিত এ শব্দটি। যদিও এর আগে ১৯৬২ সালে ‘জয় বাংলা’ শিরোনামে ছাত্রদের হাতে লেখা একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ‘৭০-এর জানুয়ারিতে এ স্লোগানটি মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। তবে স্লোগানটি জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত রূপ পায়, যখন চলচ্চিত্রের গান হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। ১৯৭০ সালে ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আবুল খায়ের ‘জয় বাংলা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস নেন, যার পটভূমি হবে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে। সে মোতাবেক চিত্রপরিচালক ফকরুল আলম চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করেন এবং ছবির গান লেখার দায়িত্ব দেন গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে। এ সময় অন্য গানগুলোর সঙ্গে গীতিকার ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি লেখেন। শাহনাজ বেগম ও আবদুল জব্বার গানটিতে কণ্ঠ দেন।
পরের ঘটনাটি সহজেই আন্দাজ করা যায়। তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকারের পক্ষে ‘জয় বাংলা’ নামে কোনো চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমতি প্রদান করার ভাবনা কল্পনাতীত। যদিও জনরোষের মুখে সে সময় জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। প্রযোজক আবুল খায়ের অবশ্য চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়ার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেননি। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তা রাও ফরমান আলীকে চলচ্চিত্রটি দেখানো হলেও কোনো আশার আলো দেখেনি তা। অবশেষে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছিল চলচ্চিত্রটি।
চলচ্চিত্রটি মুক্তির আগেই পরিচালক সালাউদ্দিনের মালিকানাধীন ‘ঢাকা রেকর্ড’ ছবিটির গান ও সংলাপ প্রকাশ করে। এ রেকর্ডের মাধ্যমেই ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি জনপ্রিয় হয়। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলাকালে প্রতিদিন স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে অনুষ্ঠান শুরুর আগে ও পরে বাজানো হতো গানটি।
“জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়
কোটিপ্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে
নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়
জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
বাংলার প্রতিঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে
আমাদের রক্ত টগবগ দুলছে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্যে
নেই ভয়
হয় হোক রক্তের প্রচ্ছদপট
তবু করি না করি না করি না ভয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
অশথের ছায়ে যেন রাখালের বাঁশরি হয়ে গেছে একেবারে স্তব্ধ
চারিদিকে শুনি আজ নিদারুণ হাহাকার আর ওই কান্নার শব্দ
শাসনের নামে চলে শোষণের সুকঠিন যন্ত্র
বজ্রের হুংকারে শৃঙ্খল ভাঙতে সংগ্রামী জনতা অতন্দ্র
আর নয়
তিলে তিলে বাঙালির এই পরাজয়
আমি করি না করি না করি না ভয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
ভুখা আর বেকারের মিছিলটা যেন ওই দিন দিন শুধু বেড়ে যাচ্ছে
রোদে পুড়ে জলে ভিজে অসহায় হয়ে আজ ফুটপাতে তারা ঠাঁই পাচ্ছে
বার বার ঘুঘু এসে খেয়ে যেতে দেবো নাকো আর ধান
বাংলার দুশমন তোষামোদী-চাটুকার সাবধান সাবধান সাবধান
এই দিন
সৃষ্টির উল্লাসে হবে রঙিন
আর মানি না মানি না কোনও সংশয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়
কোটিপ্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে
নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়
জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়।”
অলংকরন – গোলাম সাকলাইন…