প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে দুর নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক
– লেখক গীতিকবি মীর শাহ্নেওয়াজ…
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”…
বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।
সুরকারঃ আলতাফ মাহমুদ
গীতিকারঃ আবদুল গাফফার চৌধুরী
কণ্ঠ – সমবেত
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ একটি বাংলা গান, যে গানের কথায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের করুণ ইতিহাস ফুটে উঠেছে। সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে গানটি রচনা করেন। তিনি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কৃতি সন্তান।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়; এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয়। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ তিনি। লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন,
“আমি তখন ঢাকা’র আরমানিটোলার বান্ধব কুটিরে থাকতাম। সেখানে গিয়ে দেখি সরকার নোটিস দিয়েছে বান্ধব কুটিরে ছাত্ররা থাকতে পারবে না। তারপর শফিক রেহমানের বেগমবাজারের নূরপুর ভিলায় উঠলাম। সেখানে গিয়ে কবিতাটি আরও কয়েক প্যারা লিখি। আবার বাসা পাল্টে বংশালে আমার বন্ধু দাউদ খান মজলিসের বাসায় উঠি। তখন আমার এক বন্ধু আহমদ হোসেন এসে বলল, আমরা গেণ্ডারিয়াতে একটি গোপন সভা করছি। ওখান থেকে একটি লিফলেট বের হবে। কবিতাটা দ্রুত শেষ করে দাও। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তখন গীতিকারের নাম ছাপা হয়নি। পরবর্তীতে অবশ্য গীতিকারের নাম ছাপা হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে সংকলন’-এ প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।
ভাষা আন্দোলনে আমাদের যে লিফলেট বের হয় সেটা তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শিল্পী আবদুল লতিফ ভাইয়ের হাতে গিয়ে পৌঁছায়। এটি পৌঁছে দিয়েছিল রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী আতিকুল ইসলাম। আবদুল লতিফ ভাই গানটির প্রথম সুর দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করলেন। তখন আমার সামনে আইএ পরীক্ষা। এর আগেই আলতাফ মাহমুদ, যিনি সে সময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এলেন। তার বাড়ি বরিশালের মুলাদি উপজেলায়। তিনি বললেন, তোর এ গানটিকে নতুন সুর দেব। তিনি সুর দিলেন। পরে তার সুরটিই সর্বাধিক জনপ্রিয় হলো। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরির গান হলো। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। কিন্তু গান লেখা ও গাওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে আমাদের ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।”
এ গান শুনে জহির রায়হানের মাথায় আসল এ গানটি তার চলচ্চিত্রে ব্যবহার করবে। ১৯৬৯ সালে তিনি তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে এ গানটি ব্যবহার করলেন। ফলে আরও জনপ্রিয় হলো। উল্লেখ্য, বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
অলংকরন – গোলাম সাকলাইন…