Wednesday, April 24, 2024

জীবন্ত কিংবদন্তী গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এর শুভ জন্মদিন…

– রবিউল আউয়াল।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান শুধু একটি নাম নয়। বাংলা সঙ্গীত জগতের জীবন্ত এক কিংবদন্তীর নাম মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। যার কর্মে বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। তিনি প্রধানত একজন কবি। কবিতা লিখতে লিখতে যুক্ত হয়ে যান গানের কবিতা রচনায়। ক্রমেই তিনি গীতিকবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। গানের কবিতা রচনায় কাব্য, ছন্দ, অন্তমিল, শব্দচয়ন, ব্যবহারের বৈচিত্র‌তা, উপমা, রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পে তিনি হয়ে যান অদ্বিতীয়।
বর্তমান তরুন প্রজন্মের প্রাণ কিংবদন্তী গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান যশোরের নানা বাড়ী ঝিনাইদহের ফুরসুন্দি লক্ষীপুর গ্রামে ১৯৪৩ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহন করেন। এই কিংবদন্তী গীতিকবির আজ শুভ জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে জানাই শুভেচ্ছা ও ভালবাসা এবং কামনা করি তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ জীবন। আমাদের সঙ্গীত ভান্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করে ভবিষৎ প্রজন্মকে সহজ, সরল ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব সৃষ্টিতে সহায়তা করবেন।

কিংবদন্তী মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এই পর্য়ন্ত প্রায় আড়াই হাজার গান লিখেছেন। তাঁর গানের কবিতায় দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষ, জীবন-বাস্তবতা ও প্রেম-ভালবাসা, প্রকৃতির সৌন্দর্য় ইত্যাদি বিষয়গুলো চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর অসাধারন কথামালায় ও ছন্দের দোলায় সাজানো গানের কবিতা, সুর ও যন্ত্রের সংমিশ্রনে গানগুলো শ্রবণ করতেই যেন হৃদয়ে মধ্যে এক অপূর্ব অনুভতি ও ভালবাসার সঞ্চার সৃষ্টি হয়। তাঁর গানের কথায় জীবন বাস্তবতার কি অপরূপ বর্ণনা। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যেও তুমুল জনপ্রিয় অনেক গান রয়েছে –
সেই রেল লাইনের ধারে, মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা ঝরনা বলো, দুঃখ আমার বাসের রাতের পালন্ক, আকাশটা তো নীল চিঠি নয়, মাঠের সবুজ থেকে সূর্য়ের লাল, যেখানে বৃষ্টি কথা বলে, আমার মন পাখিটা যায়রে উড়ে য়ায়/ ধানশালিকের গাঁয়, ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেলেও তবু, আহা কাঙ্খে কলসী, কত হাজার বছর ধরে, আমার বাউল মনের একতারাটা, আমি বেঁচে থেকে মাখবো ধুলো, দোয়েলরে শিষ দিয়া তুই, একটি দোয়েল বনে ডাকলে, নদীর ধারেই পথ, মনরে তোর সুরে এবার মিশুক নদীর উজান ভাটী, দোয়েল পাখি গান শুনিয়ে ঘুম ভাঙ্গায়, মাঠের সবুজ থেকে সূর্য়ের লাল, যদি মরনের পরে কেউ প্রশ্ন করে, যেখানে মাটির দাওয়ায় পিদীম জ্বেলে, ও আমার বাংলাদেশ, সেই যারা ফিরলো না ঘরে/যুদ্ধের পরে, আমাকে একটি দোয়েল বলেছে, একতারা তোর বুকে এবার, আমার সাধ তো ছিলো মা, দেশের জন্য প্রেম নেই যার, আমি প্রতিদিন কথা বলি, হিজল বনের /চায়া ভেঙ্গে ভেঙ্গে, বাতাস এলেই শ্বাস টেনে মাগো নিতে চাও কার ঘ্রাণ ইত্যাদি সহ রয়েছে আরো অনেক জনপ্রিয় গান।

ব্যক্তিগত জীবনঃ
১৯৬৬ সালের ১২ জুন তিনি স্ত্রী জিন্নাত আরা জামান এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দুই কন্যা সন্তানের জনক তিনি। বড় মেয়ে সানজিদা শারমিন জামান (স্নিগ্ধা), দর্শনশাস্ত্রে এম. এ। ছোট মেয়ে সুহানা শারমিন জামান (পৃথা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এম. এ পাশ করেছেন। বর্তমানে লন্ডনের বাসিন্দা ও সেখানে শিক্ষকতা করছেন। জনাব মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান অনেক বছর যাবৎ ঢাকার হাতিরপুল ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে সস্ত্রীক বসবাস করলেও বর্তমানে তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে স্থায়ী হয়েছেন।

শিক্ষাজীবনঃ
লেখাপড়া শুরু করেন যশোর জেলা স্কুলে। ১৯৬০ সালে তিনি জেলা স্কুল থেকে ম্যট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে যশোর সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে আই. এ। ১৯৬৫ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন।
স্কুলে পড়া অবস্থাতেই ছড়া-কবিতা-গল্প এবং গান-রচনা শুরু করেন। অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার থেকেই। পিতার ছিল কবি প্রতিভা আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মো: মনিরুজ্জামান তো দেশখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অধ্যাপক ও সংগীত রচয়িতা। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কলেজ জীবনে সাহিত্য প্রতিযোগিতায়-স্বরচিত কবিতা, গল্প, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক ইত্যদিতে তাঁর পুরস্কার ছিল বাঁধা। গানের প্রতি ছিল তাঁর সহজাত আকর্ষণ। এই আকর্ষণই তাঁকে গান রচনার প্রতি বেশী প্ররোচিত করতে থাকে।

ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টেলিভিশন তাঁকে অনুমোদিত সংগীত রচয়িতা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৬৮ সালে যোগদান করেন তৎকালিন রেডিও পাকিস্তানে। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি রেডিওতেই তাঁর চাকুরী জীবন অতিবাহিত করেন। অনুষ্ঠান প্রযোজক, অনুষ্ঠান সংগঠক, সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক পদে চাকরি করেছেন দেশের প্রায় সকল বেতার কেন্দ্রে। এই সময় একাধারে গীতিকবি, কবি, নাট্যকার, নাট্যাভিনেতা, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার হিসেবে রেডিও-টেলিভিশনের স্রোতারা তাঁকে সন্মানের সাথে (সাদরে) গ্রহণ করে নেয়। ১৯৯৩ সালে চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান নিজস্ব লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৭২ সালে চলচ্চিত্রে গান লেখা শুরু করেন এবং ১৯৭৫ সালে নাট্যকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান জড়িয়ে পড়েন চিত্রনাট্য রচনায়। তারপর খ্যাতির সাথে পরিচিতি লাভ করেন, চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে সফল কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও সংগীত রচয়িতা হিসেবে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের সীমানা পেরিয়ে কলকাতার অনেক ছবির কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনা করেছেন এবং দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা ও সন্মাননা লাভ করেন। তিনি অসাধারন চিত্রাংকন করেন। তাঁর চিত্রাংকন যেন গানের মতো হৃদয়ের কথা বলে।
সেই রেল লাইনের ধারে, মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে- গানটিতে তুলে ধরেছেন এক মায়ের সন্তান যুদ্ধে গিয়েছে দেশকে স্বাধীন করার জন্য। ছেলে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে তার কাছে ফিরে আসবে। মা তার সন্তানের জন্য রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার দিকে চেয়ে আজও বসে আছে। গানটি শুনলে মনে হয়, এই তো আমার চোখের সামনেই যেন দাঁড়িয়ে আছে, আমি যেন দেখছি মা তার সন্তানের পথ চেয়ে সেই রেল লাইনের ধারে, মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে আছে।
ভারতের বোম্বের বিখ্যাত মিউজিক কোম্পানী ‘টি’ সিরিজ বের করেছে তাঁর রচিত গানের ক্যাসেটে। তাঁর রচিত পঞ্চাশাধিক কাহিনী সংলাপ চিত্রনাট্যের প্রায় প্রতিটি ছবিই বাণিজ্যিকভাবে সফল, তার মধ্যে – সোহাগ, ঘরসংসার, বৌরানী, সানাই, বদনাম, সৎভাই, ঈমান, কাজললতা, ছুটিরঘন্টা, নিশানা, ইন্সপেক্টর, অবদান, তওবা, সহযাত্রী, মর্যাদা, আদেশ, প্রতিঘাত, অগ্নিতুফান, এ্যাকসিডেন্ট, বন্ধন, আজকের হাঙ্গামা, আত্নবিশ্বাস ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের সাহিত্য নির্ভর যত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার প্রায় সবগুলির গান রচনা করেছেন তিনি। যেমন : বিরহব্যথা, কাঠগড়া, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা, রাজলক্ষী শ্রীকান্ত এবং সৎভাই।

সম্মাননা: একাধিক সন্মাননায় সন্মানিত হয়েছেন তিনি। তাঁর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্যঃ ডেইলী স্টার-স্টান্ডার্ড প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা (লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড), সুরবিতান সম্মাননা, কিংশুক সম্মাননা, পাবলিক ইনস্টিটিউট সম্মাননা(যশোর), সহকারী পরিচালক সমিতি সম্মাননা (ঢাকা), সারগাম প্রদত্ত সম্মাননা। দেশের বাইরে থেকেও তিনি বহু সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে কলাবিতান সম্মাননা-কলকাতা (ভারত), গেস্ট অবদি ইয়ার -হোটেল রাইন গোল্ড ইন্টারন্যাশনাল (জার্মানী) উল্লেখযোগ্য।

প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম:
• কোথায় লুকাব মুখ
• মরমীগীতি কাব্য: ঘোর
• প্রকাশিত পংক্তিমালা সংকলন: প্রেম সুখ অসুখের পদাবলী
• আধুনিক বাংলা গানের রচনার কলাকৌশল
• কাব্য: চন্দ্রবীক্ষণ ও নগ্নপদ্য
• নির্বাচিত গান: গীতি কবিতা সংকলন
• বাংলা গান ও বিবিধ প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ)
• মরমী গীতিকাব্য: দেহ খেয়ায় দেবো পাড়ি
• অনুবাদঃ গালিবের শের-শায়েরী
• বাংলার শের-শায়েরী
• বাংলা গানঃ রচনা কৌশল ও শুদ্ধতা
• নির্বাচিত গানঃ হৃদয়ের ধ্বনিগুল

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান আমাদের বাংলা সঙ্গীত জগতের এক নক্ষত্রের নাম। তিনি তার গানের কবিতার কাব্য, ছন্দ, অন্তমিল, শব্দচয়ন, ব্যবহারের বৈচিত্র‌্যতা, উপমা, রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে বাংলা সঙ্গীতে এনে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা। একথায় বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারে তাঁর অবদান অতুলনীয় ও অদ্বিতীয়। তাঁর সুস্থ, সুন্দর সুখী জীবন ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি। তিনি আমাদের সঙ্গীত ভুবনতে তাঁর আরো সৃজনশীল সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন ও তরুন প্রজন্মের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমকে জাগ্রত করবে।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles